মৌসুমি ফ্লুর পুরনো ধারণা ভেঙে যাচ্ছে
এক সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা বা “ফ্লু” শব্দটি শুনলেই মনে হতো—এটি শীতকালীন একটি রোগ। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই সময়টিই ছিল উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে ফ্লু মৌসুমের স্বাভাবিক সময়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ফ্লুর ঋতু বা মৌসুমের ধারা এখন পরিবর্তিত হচ্ছে।
শুধু ইউরোপ বা আমেরিকাই নয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও ফ্লুর “শিখর মৌসুম” (Peak Season) স্থান বদল করেছে।
Mayo Clinic–এর তথ্য অনুযায়ী, উত্তর গোলার্ধে সাধারণত অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত ফ্লু মৌসুম স্থায়ী থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলিতে (যেমন বাংলাদেশ), ফ্লু রোগ সারা বছরই সক্রিয় থেকে থাকে এবং বর্ষা–গ্রীষ্মকালেই অনেক সময় প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। অর্থাৎ, ফ্লু এখন “ঋতুভিত্তিক” না থেকে ক্রমশ “বছরব্যাপী” হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের ফ্লু মৌসুম: নতুন সময়, নতুন ধারা
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ফ্লু মৌসুম মূলত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ধরা পড়ে। রোগতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জুন–জুলাই মাসে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই চক্র ভেঙে গেছে।
PMC (PubMed Central)–এ প্রকাশিত একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে—
- ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুমীয় ধারা অনিয়মিত হতে শুরু করেছে।
- ২০২০ সালে COVID-19 মহামারির সময় ফ্লুর মৌসুম প্রায় ১৮ সপ্তাহ পিছিয়ে গিয়েছিল এবং তা স্থায়ী ছিল মাত্র পাঁচ সপ্তাহ।
- ২০২১ ও ২০২২ সালে, মাস্ক ব্যবহারের হ্রাস ও সামাজিক চলাচল বৃদ্ধি পেলে ফ্লুর সংক্রমণ আবার বেড়ে যায়, তবে পুরনো ঋতুর ছন্দে আর ফিরে যায়নি।
এটি প্রমাণ করে, ফ্লুর মৌসুম কেবল জলবায়ু নয়—বরং মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং ভাইরাসের নিজস্ব বিবর্তনের ওপরও নির্ভরশীল।
ফ্লু মৌসুম বদলে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণগুলো
আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন
গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্লু ভাইরাসের বেঁচে থাকা ও ছড়িয়ে পড়া তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
PMC–এর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, উচ্চ আর্দ্রতা ও উষ্ণ আবহাওয়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ভাইরাসের বিস্তারকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, অনিয়মিত বর্ষা ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রার ওঠানামা ফ্লু মৌসুমের সময়কে বারবার পরিবর্তন করছে।
ভাইরাসের জেনেটিক পরিবর্তন (Antigenic Drift ও Shift)
Pfizer–এর গবেষণা অনুযায়ী, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে “অ্যান্টিজেনিক ড্রিফট” নামের একটি ধারাবাহিক ক্ষুদ্র জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে ভাইরাস প্রতি বছর কিছুটা রূপান্তরিত হয়, এবং পূর্ববর্তী প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ভ্যাকসিন কার্যকারিতা কমে যায়।
আরও বিরলভাবে ঘটে “অ্যান্টিজেনিক শিফট”—যা বড় ধরনের রূপান্তর। তখন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভাইরাস সাবটাইপ জন্ম নেয়, যা নতুন সময় বা নতুন মৌসুমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই জেনেটিক বিবর্তনই ফ্লুর মৌসুমের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
জনস্বাস্থ্য নীতি ও আচরণের প্রভাব
PMC–এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, COVID-19 সময়কালে মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন ফ্লুর সংক্রমণ প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু সেই স্বাস্থ্যবিধি তুলে নেওয়ার পর, ফ্লু হঠাৎ করে ভিন্ন ঋতুতে দেখা দিতে শুরু করে—কখনো শীতের বদলে গ্রীষ্মে, কখনো বর্ষার পরে।
অর্থাৎ, ভাইরাসের মৌসুমি প্রকৃতি মানুষের আচরণের পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের ধারা
Mayo Clinic জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লু মৌসুম এখন অক্টোবরের পরিবর্তে নভেম্বর–ডিসেম্বরে শুরু হচ্ছে এবং কখনো কখনো জুন পর্যন্ত চলতে থাকে।
অন্যদিকে PMC–এর এক বিশ্লেষণ অনুসারে, দক্ষিণ গোলার্ধে (অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি) ফ্লুর শিখর এখন বর্ষাকালের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
এমনকি কিছু দেশে “ডুয়াল পিক” (দুইবার শিখর)—একটি গ্রীষ্মে, আরেকটি শীতে—দেখা যাচ্ছে।
এই বৈশ্বিক পরিবর্তন ইঙ্গিত দেয়, পৃথিবীর জলবায়ু ও মানুষের জীবনধারা একসঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জার ঋতু পুনর্গঠন করছে।
বাংলাদেশে এর প্রভাব ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
- হাসপাতাল চাপ বৃদ্ধি: শিখর সময় পরিবর্তিত হওয়ায় হাসপাতাল প্রস্তুতি প্রায়ই সময়মতো হয় না।
- ভ্যাকসিন পরিকল্পনায় অনিশ্চয়তা: ফ্লু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে ভাইরাসের ধরন ও মৌসুমের পূর্বাভাসের ওপর। মৌসুম বদলে গেলে টিকাদান সময়ও বদলাতে হয়।
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা কমে যায়।
- স্বাস্থ্য ঝুঁকি: প্রবীণ ও শিশুদের মধ্যে হঠাৎ ফ্লু প্রাদুর্ভাব বাড়লে মৃত্যুহারও বৃদ্ধি পেতে পারে।
সমাধান ও নীতি সুপারিশ
১. নিয়মিত নজরদারি ও গবেষণা:
ফ্লু ভাইরাসের ধারা বুঝতে সারাবছর ল্যাবভিত্তিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
PMC–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রপিকাল দেশগুলোতে সারা বছর নজরদারি করলে মৌসুম পরিবর্তনের আগাম ধারণা পাওয়া যায়।
২. টিকাদান নীতি অভিযোজিত করা:
Pfizer সুপারিশ করেছে, টিকা কার্যকর রাখতে হলে স্থানীয় মৌসুম অনুযায়ী ভ্যাকসিনেশনের সময় নির্ধারণ করতে হবে—“একই ক্যালেন্ডার নয়, বরং স্থানীয় বাস্তবতার কৌশল।”
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
Mayo Clinic বারবার জানিয়েছে—যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি (হাত ধোয়া, কাশি ঢেকে রাখা, অসুস্থ অবস্থায় বিশ্রাম নেওয়া) শুধু COVID নয়, ফ্লুর সংক্রমণও কমায়।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় আনা:
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তথ্য ফ্লু মডেলে অন্তর্ভুক্ত করলে আগাম সতর্কতা জারি করা সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুমের যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা শুধুমাত্র আবহাওয়ার ফল নয়—এটি মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ভাইরাসের বিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাব।
বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে ফ্লু আর শুধু “শীতকালীন রোগ” নয়; এটি এখন বর্ষা ও গ্রীষ্মকালের হুমকি।
Mayo Clinic, Pfizer, এবং PMC–এর গবেষণা এক কথায় সতর্ক করছে—
ফ্লুর সময় বদলেছে, তাই প্রতিরোধের কৌশলও নতুনভাবে সাজাতে হবে।
#ফ্লু_মৌসুম #ইনফ্লুয়েঞ্জা #বাংলাদেশ #MayoClinic #Pfizer #PMC #সারাক্ষণ_রিপোর্ট