করাচি চিড়িয়াখানার গল্প কেবল প্রাণীদের নয়—এটি মানবতার বিবেকের আয়না। বন্দিত্ব, অবহেলা ও ‘শিক্ষা’র নামে নির্মিত এই বিনোদনকেন্দ্র আজ এক ভয়ংকর প্রতিফলন, যেখানে আনন্দের আড়ালে মরে যাচ্ছে জীবনের মর্যাদা।
ভূমিকা: শিক্ষার নামে বন্দিত্বের মৃত্যু
করাচি চিড়িয়াখানার ট্র্যাজেডি কেবল খাঁচায় বন্দী প্রাণীদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর গল্প নয়—এটি আমাদের নিজেদের নৈতিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ প্রতিফলন।
আমি জীবনে কখনও চিড়িয়াখানায় পা রাখিনি—এবং এখন মনে হয়, রাখা উচিতও হয়নি।
আমি এমন এক মা, যার ঘর শাসন করে দুই রাজবংশীয় বিড়াল। এছাড়া আমি পথভোলা প্রাণীদের স্বঘোষিত অভিভাবকও বটে। ভালোবাসা সম্পর্কে আমার শিক্ষা এসেছে লোমে মোড়া শরীর আর গোঁফের নরম ছোঁয়া থেকে। বিড়ালরা ভালোবাসে, কিন্তু স্বাধীনতাকে কখনও ত্যাগ করে না। তারা শেখায়—স্নেহও হতে পারে তীব্র, কিন্তু আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়।
স্বাধীনতাই যেখানে মর্যাদার নিশ্বাস, সেখানে বন্দিত্ব মানে সেই মর্যাদার ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ।
আর মানুষের আনন্দ ও তথাকথিত “শিক্ষা”-র নামে নির্মিত খাঁচাগুলোয় এই শ্বাসরোধ এত প্রকাশ্যে আর কোথাও দেখা যায় না।
করাচি চিড়িয়াখানায় প্রবেশ: এক সাংবাদিকের দুঃসহ দিন
যখন সম্পাদক আমাকে করাচি চিড়িয়াখানা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে বললেন, তখনই বুঝেছিলাম—এটি সেই হালকা সকালবেলার রিপোর্ট নয় যা দুপুরের আগে জমা দেওয়া যায়।
এই গল্প ভারি হয়ে থাকবে হৃদয়ের ওপর।
কিন্তু সাংবাদিকতা বাস্তবতার কাছে দায়বদ্ধ। ব্যক্তিগত অনীহা তার কোনো ছুটি নেয় না।
চিড়িয়াখানা থাকবে—আমি চাইলেও মুছে যাবে না।
আমার কাজ হলো সাক্ষী থাকা।
তাই গেলাম।
হৃদয়ের এক সরল কোণ এখনও আশা করেছিল—হয়তো কিছুটা সৌন্দর্য বা মানবিকতা খুঁজে পাব।
কিন্তু পাইনি।
প্রাণবন্ত চিড়িয়াখানা, কিন্তু প্রাণহীন প্রাণী
ভুল বুঝবেন না—চিড়িয়াখানা ভরপুর ছিল প্রাণে, তবে তা খাঁচার ভেতরের প্রাণ নয়, দর্শনার্থীদের।
সিংহের গর্জন, পাখির ডাক বা বানরের কোলাহল—যে শব্দগুলোর আশা করা যায় এমন জায়গায়—কোথাও নেই।
তার বদলে বাজছিল নব্বইয়ের দশকের বলিউড গানের আওয়াজ, লাউডস্পিকারে ভেসে আসা সস্তা আনন্দের সুর।
শিশুরা আনন্দে চিৎকার করছে, কেউ ট্রামপোলিনে লাফাচ্ছে, কেউ ফুটবল খেলছে।
পরিবারগুলো রোদে ঝলমলে ঘাসের ওপর চাদর পেতে ছোটখাটো পিকনিকে মগ্ন।
কিছু দূরে বিশাল লাইন—নৌকা ভ্রমণের অপেক্ষায় মানুষজন।
জলের এমন বিস্তৃত জায়গা দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো এই জায়গাটিই খাঁচাগুলোর জায়গা বাড়াতে ব্যবহার করা যেত।
চিড়িয়াখানায় “বিনোদন” যেন এক অন্তহীন ভোগের মেলা—জিপলাইন, ৩ডি সিনেমা, শিশুদের বোলিং অ্যালি, নকল লন্ডনবাসে ভ্রমণ, সারিবদ্ধ ক্যাফে।
দ্য ফরেস্ট ক্যাফে: মানুষের আনন্দ বনাম প্রাণীর বেদনা
আমার পছন্দের জায়গা ছিল “দ্য ফরেস্ট ক্যাফে”—অর্ধ-খোলা আকাশের নিচে, গাছের শিকড়-পাতা জড়িয়ে তৈরি ছাউনি, ঝুলন্ত বাতি, আর প্লাস্টিকের সাদা চেয়ার।
আলোর হলুদ বলগুলো জোনাকির মতো ঝিকমিক করছে।
প্রত্যেক বিবরণে যত্ন ও রুচি—যা একটিবারও প্রাণীদের খাঁচায় দেখা যায়নি।
তাদের জায়গা নিঃস্ব, নির্জন, প্রাণহীন।
এ যেন এক উৎসব—মানুষের আনন্দের উৎসব—যার পটভূমিতে কেবল সেইসব প্রাণীর যন্ত্রণা, যারা কখনও স্বাধীনতার স্বাদই পায়নি।
Survival of the ‘Unfittest’: রাজা এখন বন্দী
প্রথমেই দেখা হলো বনের রাজাকে—তবে সে এখন রাজা নয়, পরাজিত এক প্রাণ।
একটি সিংহ নিথর হয়ে শুয়ে আছে। আধখোলা চোখে গভীর ক্লান্তি—যে ক্লান্তি কেবল বন্দিত্বই দিতে পারে।
একসময় যার শিরায় প্রবাহিত হতো তেজ, আজ তার শরীর নিস্তেজ, প্রাণহীন।
তার “রাজ্য”—মাত্র ২০x২০ ফুটের একটি জায়গা।
অর্ধেকজুড়ে স্থবির সবুজ পুকুর, পাশে একমাত্র শুকনো পাতাহীন ডাল।
খাঁচার বাইরে ভিড় করে আছে আগ্রহী মুখগুলো—অপেক্ষা করছে কিছু ঘটবে বলে।
কিন্তু রাজা এখন অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে।
যত বাঁশি বাজুক, যত হাততালি পড়ুক—সে নড়ল না একটুও।
আমি খাতায় নোট নিচ্ছিলাম, হঠাৎ পাশে এক শিশু কণ্ঠস্বর উঠল—
“মামা, দেখো! সাদা সিংহ!”
মা বিস্ময়ে বললেন, “সাদা? ও তো বাদামি দেখাচ্ছে।”
ছেলে জেদ করে বলল, “বোর্ডে লেখা আছে, এটা সাদা সিংহ।”
দুজনেই ঠিক বলছিল।
সিংহ আসলে সাদা জাতের, কিন্তু তার লোম এত ময়লায় আচ্ছাদিত যে রং হয়ে গেছে মলিন বাদামি।
কোনও পরিচর্যা নেই, নেই পরিচ্ছন্নতা।
তার খাঁচার পাশে ব্যঙ্গাত্মকভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক রেস্টুরেন্ট—“ক্যাফে দ্য লায়ন”।
রাজা যখন ক্ষয়ে যাচ্ছিল তার ক্ষুদ্র রাজ্যে, তখন তার নাম ব্যবহার হচ্ছিল স্থানীয় ফাস্টফুডে।
মানুষ সেখানে চাট ও বন-কাবাবে মশগুল, পাশে কৃত্রিম জলপ্রপাতের ছিটা উপভোগ করছে।
তাদের কারও পরোয়া নেই—কয়েক ধাপ দূরে এক রাজা মনস্তাত্ত্বিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
অবসন্ন বানর, ক্ষতবিক্ষত দেহ
অল্প দূরেই মরচেধরা খাঁচায় কিছু বানর।
একটি খাচ্ছে মরিচা ধরা লোহার টুকরো; অন্যটি বারবার ঘুরছে এক বৃত্তে—পিঠে বড় ক্ষত, নেই ব্যান্ডেজ, নেই কর্মচারী।
তাদের খাঁচা নিঃস্ব—না দড়ি, না গাছ, না এমন কিছু যা প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুকরণ করে।
শুধু ধূসর টাইলসের মেঝে—না মাটি, না ঘাস।
যেখানে বনের বানররা গাছে দোলে, পাতার শব্দে বাঁচে, সেখানে এই বন্দীরা হারিয়েছে তাদের সব প্রবৃত্তি।
রানো: এক বিষণ্ন ভালুকের গল্প
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছিল হিমালয়ের বাদামি ভালুক “রানো”-কে দেখা।
তার শরীর ও মন স্পষ্টভাবে বন্দিত্বজনিত মানসিক রোগে ভুগছে।
যে ভালুকের ঘর হওয়া উচিত ছিল দিওসাই জাতীয় উদ্যানের তুষারাচ্ছন্ন প্রান্তর, সে এখন বন্দী গরমে, কংক্রিটে, আর ঘামে।
সে হাঁটছে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে—বাম থেকে ডান, ডান থেকে বাম—একই ছন্দে, অনবরত।
জীবন যেন এক লুপে আবদ্ধ।
এর জন্য পশু আচরণ বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না; কেবল মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়—কিছু ভয়াবহ ভুল হচ্ছে।
ভাবছিলাম—করাচির নির্মম গরম যদি মানুষকেও গলিয়ে দেয়, তবে উত্তরাঞ্চলের এই ঠান্ডা-পছন্দ প্রাণীর কী অবস্থা হতে পারে?
তার নেই তুষার, নেই বন, নেই আশ্রয়—শুধু একটি মৃত গাছের গুঁড়ি, যেন উপহাস করছে তার হারানো স্বাধীনতাকে।
পচা ক্ষত ও অবহেলার সাক্ষ্য
সম্প্রতি জানা গেছে, রানো’র মাথায় গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে—নিজের খাঁচার লোহার দণ্ডে আঘাত করতে করতে।
ক্ষত এখন পচে গিয়েছে, তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে পোকা।
এটাই বছরের পর বছর তার প্রতি অবহেলার সবচেয়ে নির্মম প্রমাণ।