চিকিৎসক থেকে আন্দোলনকর্মী: কেসি মিনসের যাত্রা
সাত বছর আগে কেসি মিনস ছিলেন এক প্রতিশ্রুতিশীল সার্জন। স্ট্যানফোর্ডে পড়াশোনা শেষে তিনি উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক রেসিডেন্সিতে যোগ দেন, কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎই পদত্যাগ করেন। কারণ—তিনি মনে করেন, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে শুধু চিকিৎসা-ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এরপর তিনি হয়ে ওঠেন স্বাস্থ্য উদ্যোক্তা, লেখক ও অনলাইন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
২০২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই “গুড এনার্জি: দ্য সারপ্রাইজিং কানেকশন বিটুইন মেটাবলিজম অ্যান্ড লিমিটলেস হেলথ”-এ তিনি লিখেছিলেন, “আমরা ‘বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করো’ কথাটি শুনতে শুনতে এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি যেখানে মানুষ প্রশ্ন করতেও ভয় পায়।”
মেটাবলিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ‘গুড এনার্জি’ আন্দোলন
ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা এখন ৮ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। সেখানে তিনি নিয়মিত প্রচার করেন—ভালো খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এবং দেহের বিপাকীয় স্বাস্থ্য (metabolic health) ঠিক রাখাই দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।
তাঁর এই ধারণা ঘিরেই গড়ে উঠেছে রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের নেতৃত্বাধীন Make America Healthy Again (MAHA) আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও জীবনধারাজনিত অসুস্থতা হ্রাস করা।
সমালোচনা: বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাকি অতিরঞ্জন?
চিকিৎসাবিদদের একাংশ আশঙ্কা করছেন, মিনস সার্জন জেনারেল হলে তিনি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের চেয়ে জীবনধারাগত তত্ত্বকে বেশি প্রাধান্য দিতে পারেন। সাবেক সার্জন জেনারেল জেরোম অ্যাডামস বলেন, “কেনেডি ও কেসি মিনস প্রায়ই এমনভাবে বক্তব্য দেন যা আংশিক সত্য হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে বিভ্রান্তিকর হতে পারে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগ (HHS) মিনসকে “বিশ্বমানের চিকিৎসক ও গবেষক” হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছে, তাঁর মনোনয়ন প্রমাণ করে আধুনিক মেটাবলিক স্বাস্থ্যের ওপর তাঁর গভীর জ্ঞান এবং প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার।
বিতর্কিত আর্থিক সম্পর্ক
‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের পর থেকে তিনি বিভিন্ন স্বাস্থ্যপণ্য, সাপ্লিমেন্ট ও ওয়েলনেস ব্র্যান্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে ৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারেরও বেশি আয় করেছেন। তিনি একাধিক নিউজলেটার ও ইউটিউব ভিডিওতে এসব ব্র্যান্ডের প্রচার করেছেন—যদিও সব ক্ষেত্রে আর্থিক সম্পর্ক স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন truthinadvertising.org
তবে HHS জানিয়েছে, মিনস সব নৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলবেন। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে সার্জন জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পেলে তাঁর নিউজলেটার ও বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক কার্যক্রম বন্ধ করবেন।
বই ও খাদ্যদর্শন: ‘নিজেকে বিশ্বাস করো, ডাক্তারকে নয়’
মিনস ও তাঁর ভাই ক্যালি মিনসের সহ-লিখিত বই “গুড এনার্জি” কার্যত MAHA আন্দোলনের এক ম্যানিফেস্টো। এতে এক অধ্যায়ের নামই হলো “নিজেকে বিশ্বাস করো, ডাক্তারকে নয়।”
তিনি আল্ট্রা-প্রসেসড খাবারকে “বিষাক্ত ও প্রাণহীন খাবার” বলে বর্ণনা করে বলেন, এসব পণ্য মানুষ ও পৃথিবী উভয়কেই অসুস্থ করছে। তিনি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড কোকা-কোলা, হেইঞ্জ, গেটরেড ও ক্র্যাফটের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন।
পুষ্টিবিদেরা তাঁর প্রসেসড ফুড-বিরোধী অবস্থানকে সাধুবাদ জানালেও সতর্ক করেছেন—সব ধরনের প্রসেসড খাবার সমান ক্ষতিকর নয়। যেমন কিছু রুটি বা চিনাবাদাম মাখনে উপকারী উপাদানও থাকে।
টিকা নিয়ে বিতর্ক
২০২৪ সালের বইটিতে তিনি টিকার কথা উল্লেখ করেননি, কিন্তু পরবর্তীতে একাধিক পডকাস্টে শিশুর টিকাদান সূচি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “একটা টিকা হয়তো অটিজমের কারণ নয়, কিন্তু যখন ১৮ মাস বয়সের আগেই ২০টা টিকা দেওয়া হয়, তখন প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক।”
বিজ্ঞানীরা একমত—টিকা ও অটিজমের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মিনসের এই মন্তব্য তাঁর ভাই ক্যালির মতোই বিতর্ক উসকে দেয়। তবু ক্যালি মিনস বলেন, “কেসিকে কেউ কখনো অতিরিক্ত টিকা-বিরোধী, আবার কেউ অতিরিক্ত টিকা-পন্থী বলে অভিযুক্ত করেছেন—এটাই প্রমাণ করে, তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করেন।”
সার্জারি ছেড়ে বিকল্প চিকিৎসায় ঝোঁক
স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে পাস করার পর মিনস ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে কান, নাক ও গলা সার্জারির রেসিডেন্সিতে যোগ দেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর সহকর্মীরা বলেন, “তিনি রোগীদের সুস্থ করতে পারছেন না—এই ধারণা তাঁকে হতাশ করেছিল।”
এরপর তিনি ‘ফাংশনাল মেডিসিন’-এর পথে হাঁটেন—একটি পদ্ধতি যা রোগের মূল কারণ ও জীবনধারার পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেয়। এই শাখাকে এখনো মার্কিন চিকিৎসা বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবে সমর্থকেরা মনে করেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ মোকাবিলায় কার্যকর।
প্রযুক্তি, উদ্যোগ ও নতুন ভাবনা
মিনসের ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি ‘লেভেলস’ নামের একটি হেলথ টেক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন, যা ডায়াবেটিস নেই এমন মানুষদেরও গ্লুকোজ মনিটর ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। তিনি কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করেন।
যদিও অনেক চিকিৎসক বলেন, ডায়াবেটিস নেই এমন মানুষের জন্য এই প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিকাল এন্ডোক্রাইনোলজি জানায়, “এখনও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই যে এসব ডিভাইস সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী।”
আধ্যাত্মিকতা ও স্বাস্থ্য: শরীরের সঙ্গে আত্মার সংযোগ
মিনস প্রায়ই বলেন, শরীর ও আত্মার ভারসাম্যই স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চাবিকাঠি। এক নিউজলেটারে তিনি লিখেছিলেন, “নিজেকে ঈশ্বরের এক সৃষ্টিশক্তির অংশ হিসেবে গড়ে তোলাই সর্বোচ্চ সুস্থতার পথে নিয়ে যায়।”
তাঁর এই ভাবনা এখন MAHA আন্দোলনের নারীদের—যাদের “MAHA Moms” বলা হয়—মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। কেনেডি নিজেও বলেছেন, “মিনসের চিন্তাধারা আমেরিকার প্রতিটি মায়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।”
নতুন যুগের চিকিৎসা দর্শন না কি বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি?
কেসি মিনস এখন মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত সার্জন জেনারেল মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী। সমর্থকেরা তাঁকে দেখছেন “জাতির চিকিৎসক” হিসেবে—যিনি জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। সমালোচকেরা আশঙ্কা করছেন, তাঁর বক্তব্য ও কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল করে দিতে পারে।
যেভাবেই দেখা হোক না কেন, মিনসের মনোনয়ন মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামোর বাইরে এক সাহসী ও বিতর্কিত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
#হেলথ_পলিটিক্স #কেসি_মিনস #মার্কিন_স্বাস্থ্যনীতি #MAHA #রবার্ট_এফ_কেনেডি_জুনিয়র #সারাক্ষণ_রিপোর্ট