স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বিলাসবহুল ট্রেন—
ভিয়েতনামের ট্রেনে নতুন অভিজ্ঞতা
ভিয়েতনামের রেল বিভাগ সম্প্রতি চালু করেছে পর্যটকদের জন্য বিশেষ ট্রেন সেবা—যেখানে যাত্রীরা পাবেন বিলাসিতা, স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া ও ইতিহাসের স্বাদ একসঙ্গে। এসব ট্রেন শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং দেশের ঐতিহ্য ও পর্যটনের নতুন পরিচায়ক হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে।
হানয় ট্রেন: শহর ও ইতিহাসের সেতুবন্ধন
৬ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া ‘হানয় ট্রেন’ দিনে তিনবার হানয় স্টেশন থেকে বকনিন প্রদেশের তু সন স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করে, যা রাজধানী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। এই যাত্রা তিন থেকে চার ঘণ্টা স্থায়ী হয়, এবং এর মধ্যে যাত্রীরা ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের সুযোগ পান। ট্রেনে পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত, পদ্মফুলের চা এবং স্থানীয় খাবার।
টিকিটের দাম ৫৫০,০০০ ডং (প্রায় ২১ ডলার) থেকে শুরু হয়ে ভিআইপি আসনের জন্য ৭৫০,০০০ ডং পর্যন্ত। বেশিরভাগ যাত্রী ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘আও দাই’ পরে ট্রেনে ওঠেন এবং স্মৃতিচারণমূলক ছবি তোলেন।
ট্রেনে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মিলন
লেখকহানয় ট্রেন ডিজেলচালিত পুরোনো মডেলের হলেও, এর যাত্রাপথে লুকিয়ে আছে ভিয়েতনামের রঙিন ইতিহাস। ট্রেনটি রেড রিভার পেরিয়ে লং বিয়েন ব্রিজের ওপর দিয়ে যায়, যা শতবর্ষী স্থাপত্য নিদর্শন। যাত্রার অন্যতম আকর্ষণ তু সন স্টেশনে নামার পর শাটল বাসে করে দো মন্দির পরিদর্শন।
এই মন্দিরে ১১ থেকে ১৩ শতকের লি রাজবংশের আট সম্রাটকে সম্মান জানানো হয়। বিশেষ করে লি থাই তো—যিনি হানয় শহরকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—তাঁর প্রতিকৃতির সামনে ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন যাত্রীরা। সেখানে বাজানো হয় ঐতিহ্যবাহী বাক নিন সঙ্গীত ও স্থানীয় জনপ্রিয় গান ‘বাক ব্লিং’।
যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা
৫৯ বছর বয়সী এক যাত্রী বলেন, “ট্রেনের পরিবেশ পরিষ্কার ও মনোমুগ্ধকর।” অন্য এক যাত্রী জানান, “দো মন্দিরে প্রথমবার এসে লি রাজবংশের ইতিহাস জেনে সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়েছি। ভিআইপি আসনের দামও খুব বেশি নয়, পরের বার পরিবার নিয়ে আসব।”
পর্যটন সংস্থা বিএইচএল-এর চেয়ারম্যান তাও ডুক হিয়েপ বলেন, “আমরা এই ট্রেনের ধারণা দিয়েছিলাম হানয় ও তু সনের সংস্কৃতিকে একসূত্রে বাঁধার উদ্দেশ্যে। মানুষ যেন ভিয়েতনামের ঐতিহ্যকে কাছ থেকে অনুভব করতে পারে—এটাই মূল লক্ষ্য।”
সেবার কিছু সীমাবদ্ধতা
যদিও ট্রেনটি নতুনভাবে চালু হয়েছে, কিছু সমস্যা এখনও বিদ্যমান। যেমন, ভিআইপি আসনের ঠান্ডা বেশি হওয়া, হঠাৎ ট্রেন চলা শুরু হওয়ায় যাত্রী পড়ে যাওয়া, বা জানালা দিয়ে দৃশ্য ও ট্রেনের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্যের ঘাটতি।
নতুন নতুন পর্যটন ট্রেনের উত্থান
এ বছরের মে মাসে ‘হোয়া ফুয়ং দো’ নামের আরেকটি পর্যটন ট্রেন চালু হয়, যা মে-জুন মাসে ফুটে ওঠা লাল রাজকীয় ফুলের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এটি হানয় থেকে হাই ফং পর্যন্ত চলে—যে শহরটি ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত রেলস্টেশন ও বন্দর শহর হিসেবে পরিচিত।
শুক্র ও শনিবার ভিআইপি আসনের দাম ৩০০,০০০ ডং এবং সাধারণ আসনের ১৩০,০০০ ডং, তবে সপ্তাহের অন্যদিনে দাম ২০ শতাংশ কম।
আরেকটি ছোট রুটে, কুই নন থেকে দিয়ু ত্রি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের পথ জুড়ে আরেক ট্রেন চলে, যেখানে যাত্রীরা সৈকত ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন মাত্র ১৫০,০০০ ডংয়ে।
বিলাসবহুল ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণ
গত জানুয়ারিতে চালু হয়েছে ‘এসজার্নি’ নামের বিলাসবহুল ট্রেন, যা ৮ দিন ৭ রাত ধরে হো চি মিন সিটি থেকে হানয় পর্যন্ত চলাচল করে। এই ভ্রমণের খরচ প্রায় ৯,৮৯০ ডলার, যা মূলত দেশি-বিদেশি ধনী পর্যটকদের জন্য পরিকল্পিত।
ট্রেনভিত্তিক পর্যটনের উত্থান
ভিয়েতনামে ট্রেন ভ্রমণের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করছে, যাত্রা এখন শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয় নয়, বরং অভিজ্ঞতারও অংশ। যদিও ভিয়েতনামের মাথাপিছু আয় জাপানের এক-পঞ্চমাংশেরও কম, শহরাঞ্চলে ক্রমেই বেড়েছে ভোক্তাদের ব্যয়ক্ষমতা—যেখানে আইফোন ও স্টারবাকস এখন সাধারণ দৃশ্য।
ট্রেন পরিকল্পনাকারী তাও ডুক হিয়েপ বলেন, “এই ট্রেন তৈরি করার আগে আমি জাপানের বিভিন্ন ট্রেনে চড়ে গবেষণা করেছি।”
ভিয়েতনামের নতুন পর্যটন ট্রেনগুলো স্থানীয় ঐতিহ্য, সংগীত, ইতিহাস ও আতিথেয়তাকে মিলিয়ে এমন এক অভিজ্ঞতা দিচ্ছে যা দেশি ও বিদেশি উভয় ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এটি শুধু ভ্রমণ নয়, বরং ভিয়েতনামের আত্মপরিচয়ের এক জীবন্ত প্রদর্শনী।
#ভিয়েতনাম #রেলভ্রমণ #পর্যটন #হানয়_ট্রেন #দো_মন্দির #সারাক্ষণ_রিপোর্ট