চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরান জেন্ডার পরিবর্তন অস্ত্রোপচারে বিশ্বে অন্যতম সক্রিয় দেশ। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে এক বিতর্কিত ইতিহাস—যেখানে সমকামী ও জেন্ডার–ননকনফর্মিং নাগরিকদের অনেককেই বাধ্যতামূলকভাবে সার্জারির মুখে পড়তে হয়েছে, না হলে অপেক্ষা করেছে মৃত্যুদণ্ড।
আজ, যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় দেশটি তার সেই চিকিৎসা দক্ষতাকে বৈদেশিক আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকার এখন এই খাত থেকে বছরে ৭০০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য নিয়েছে—যা গত বছরের আয় থেকে সাতগুণ বেশি।
চিকিৎসা পর্যটনের উত্থান
ইরানে এখন একের পর এক মেডিকেল ট্যুরিজম কোম্পানি গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠান কেবল নাক সারানো বা চুল প্রতিস্থাপন নয়, বরং ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি, মাসটেকটমি ও পেনিস নির্মাণের মতো অস্ত্রোপচারের প্রচার চালাচ্ছে বিলাসবহুল প্যাকেজে।
মাবনাট্রিপ ও মেডপ্যালট্রিপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ফারিদেহ নাজাফি বলেন, “আমরা হোটেল বুকিং থেকে হাসপাতাল, পরিবহন—সবকিছুই পরিচালনা করি, যাতে রোগীদের অভিজ্ঞতা হয় চাপমুক্ত ও স্বস্তিদায়ক।”
এই উদ্যোগে ইরান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ট্রান্স-ফ্রেন্ডলি দেশ হিসেবে তুলে ধরছে, যেখানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা সরকার-সাবসিডি পায় এবং আইনত অস্ত্রোপচারের অনুমতি রয়েছে।
কম খরচে অস্ত্রোপচারের প্রতিশ্রুতি
ইরানমেডট্যুর নামে একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি জেন্ডার কনফার্মেশন সার্জারির খরচ যেখানে প্রায় ৪৫ হাজার ডলার, থাইল্যান্ডে ৩০ হাজার ডলার, সেখানে ইরানে এই খরচ ১২ হাজার ডলারেরও কম। সরকারি হাসপাতালে তা নামানো যায় মাত্র ৪,৫০০ ডলারে।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের রোগীরা যেমন আসছেন, তেমনি ইরাকের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকেও অনেকেই চিকিৎসা নিতে ছুটে আসছেন, যেখানে এসব চিকিৎসা নিষিদ্ধ।
অস্ত্রোপচারের আড়ালে লুকানো বাস্তবতা
তবে এই বাহ্যিক উন্নতির পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানে সমকামী পুরুষ ও নারীদের অনেককেই জোরপূর্বক জেন্ডার পরিবর্তন সার্জারিতে বাধ্য করা হয়েছে, কারণ তারা ট্রান্স না হয়েও অন্যথায় মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে ছিলেন।
ইরানের সমাজে সমকামিতা এখনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ; প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অনেকেই বাঁচার উপায় হিসেবে সার্জারি বেছে নিতে বাধ্য হন।
ট্রান্স অভিনেতা সামান আরাস্তু বলেন, “ইরানকে ট্রান্স স্বর্গ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। ট্রান্স মানুষদের অবস্থা ভয়াবহ।”
খোমেনির ফতোয়া ও ইতিহাসের সূত্রপাত
ইরানে এই সার্জারির সূচনা ১৯৮০–এর দশকে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির এক ফতোয়া থেকে, যেখানে বলা হয়েছিল—কোনো ব্যক্তি যদি জেন্ডার পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করেন, তবে সার্জারির মাধ্যমে তা বৈধভাবে করতে পারবেন।
এই ফতোয়া একদিকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়, অন্যদিকে তা জোরপূর্বক অস্ত্রোপচারের পথও খুলে দেয়। কারণ যারা প্রচলিত নারী–পুরুষ ধারণার বাইরে থাকতে চান কিন্তু সার্জারি করতে চান না, তাদের উপরও চাপ সৃষ্টি হয়।
সুইডেনের ওরেব্রো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার গবেষক জারা সাঈদজাদে বলেন, “ইরানে ট্রান্স হওয়া মানেই সার্জারি করা বাধ্যতামূলক। কেউ যদি কেবল পরিচয়ে ট্রান্স থাকেন কিন্তু শরীর পরিবর্তন না করতে চান, তাহলে সমাজে তাকে ‘নিয়মভঙ্গকারী’ হিসেবে দেখা হয়, এমনকি তার জীবন হুমকির মুখে পড়ে।”
পালিয়ে যাওয়া কর্মী ও প্রতিবাদের কণ্ঠ
রাহা আজৌদানি, ২০ বছর বয়সী এক ট্রান্স নারী ও কর্মী, ২০২৪ সালে ইরান থেকে পালিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নেন। কারণ, তাকে বাধ্যতামূলক সার্জারির হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং তার মানবাধিকার কর্মসূচির জন্য দুইবার গ্রেপ্তারও করা হয়।
তিনি বলেন, “আমি কখনোই লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইনি। আমি নিজেকে নারী বা পুরুষের প্রচলিত ধারণার বাইরে সংজ্ঞায়িত করেছি। খোমেনির ফতোয়ার শর্তে নিজেকে মানাতে রাজি ছিলাম না।”
নিরাপত্তা ও চিকিৎসা জটিলতার আশঙ্কা
ইরানে এই অস্ত্রোপচারের মান নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। জাতিসংঘের ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—“বেশ কিছু সার্জারিতে গুরুতর রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, ব্যথা, অস্বাভাবিক দাগ এবং বিকৃত অঙ্গসংস্থান” দেখা গেছে।
তবু মেডিকেল ট্যুর কোম্পানিগুলো ‘এক সপ্তাহে সম্পন্ন’ প্যাকেজ অফার করছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে একেবারেই অস্বাস্থ্যকর।
তেহরানের ইউরোলজিস্ট ড. শাহরিয়ার কোহানজাদ, যিনি ৩০০–এরও বেশি ট্রান্স সার্জারি করেছেন, সতর্ক করে বলেন, “এমন জটিল অস্ত্রোপচারে রোগীর সঙ্গে যথেষ্ট সময় ব্যয় করা অপরিহার্য। দ্রুত সার্জারি মানে ঝুঁকিপূর্ণ ফলাফল।”
সস্তা চিকিৎসা ও নৈতিক প্রশ্ন
কানাডায় বসবাসরত ৪৫ বছর বয়সী ট্রান্স পুরুষ এরিক বলেন, “ইরানে চিকিৎসা অনেক সস্তা, তাই এসেছিলাম। কিন্তু জানি, অনেকেই বাধ্য হয়ে এই অস্ত্রোপচার করাচ্ছে, যা গভীরভাবে বেদনাদায়ক।”
তিনি আরও যোগ করেন, “সমকামী পুরুষ ও নারীরা ইরানে স্বীকৃতি পান না, অথচ ট্রান্স মানুষরা সার্জারি করাতে পারেন—এই দ্বৈত বাস্তবতা সমাজের গভীর সংকটকে তুলে ধরে।”
ইরান এখন বিশ্বের ট্রান্স সার্জারি মানচিত্রে একটি বড় নাম। কিন্তু এর সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জোরপূর্বক শরীর পরিবর্তনের ইতিহাস। চিকিৎসা পর্যটনের নামে যেভাবে দেশটি নতুন আয়ের উৎস তৈরি করছে, তাতে অর্থনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি মানবিক প্রশ্নও ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
#ইরান, #জেন্ডার_পরিবর্তন, #মেডিকেল_ট্যুরিজম,# মানবাধিকার, #আন্তর্জাতিক_#অর্থনীতি, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট