নরকীয় কালো কুকুরের গির্জায় হামলা থেকে শুরু করে নির্জন সড়কে লালচে চোখওয়ালা হিংস্র প্রাণী—ব্রিটেন বহুদিন ধরেই আতঙ্ক জাগানো কুকুরভূতের গল্পে আচ্ছন্ন। এসব কাহিনি আমাদের অতীত সমাজ সম্পর্কে কী বলে—তা বিশ্লেষণ করেছেন ক্যারেন আর জোন্স।
কালো কুকুরের কিংবদন্তি: বাংগের অদ্ভুত সকাল
১৫৭৭ সালের ৪ আগস্ট রোববার সকালে সুফোকের বাংগে শহরের সেন্ট মেরি গির্জায় নিয়মিত প্রার্থনার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু আকাশে জমেছিল আরও ভয়ংকর কিছু—গাঢ় মেঘ, ভয়াল বজ্রঝড়। আব্রাহাম ফ্লেমিং-এর সমসাময়িক পুস্তিকায় এ ঝড়কে বলা হয় “অতিশয় ভয়ংকর প্রলয়”, কেবল বৃষ্টি নয়, প্রবল বজ্রপাত ও গর্জন। ঝড় থামার সঙ্গে সঙ্গে গির্জা ডুবে যায় অন্ধকারে এবং সেখানে প্রবেশ করে “একটি কালো কুকুর—অথবা শয়তান, কুকুরের বেশে”—যে মুহূর্তে দুজন উপাসকের ঘাড় মটকে দেয়। আরেকজনের পিঠে এমনভাবে আঁচড় কাটে যে তিনি “গরম আগুনে সেঁকা চামড়ার মতো” কুঁকড়ে যান।
বাংগের এই ব্ল্যাক ডগের গল্প অসাধারণ বটে, কিন্তু অনন্য নয়। বিশেষত পূর্ব অ্যাংলিয়ায় ‘ব্ল্যাক শাক’ নামে পরিচিত অতিপ্রাকৃত কুকুরের কিংবদন্তি সবচেয়ে প্রচলিত—এবং তা গোটা ব্রিটেন জুড়েই ছড়িয়ে আছে।
ব্রিটেনে কুকুর ও মানুষ: প্রাগৈতিহাসিক সখ্য
ব্রিটেন বিখ্যাত ‘প্রাণীপ্রেমী’ জাতি; ঘরবাড়ির প্রায় এক-তৃতীয়াংশে অন্তত একটি কুকুর আছে। পোষ্য কুকুরের বাজার বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ড—দর্শকেরাও কুকুরকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ। পাথর যুগে প্রথম মানব অভিবাসীদের সঙ্গে গৃহপালিত কুকুর এ দ্বীপে আসে—তারপর থেকে তারা আমাদের বিশ্বস্ত সহচর।
লোককথাবিদ মার্ক নরম্যানের মতে, অতিপ্রাকৃত কুকুরের বৈচিত্র্য ও বিস্তারে ব্রিটেন বিশ্বে অনন্য। অ্যাবারডিন থেকে পেঞ্জ্যান্স—গ্রাম, জনশূন্য পথ, পাহাড়ি ঢালে তাদের পদচারণার গল্প শোনা যায়; রাতভর শোনা যায় তাদের শীতল হুঙ্কার।
প্রাচীন বসতি থেকে শিকারক্ষেত্র: লোককথায় কুকুরের পদচিহ্ন
মেসোলিথিক যুগ থেকেই মানুষ-কুকুর একসঙ্গে ব্রিটেনে চলেছে। ইয়র্কশায়ারের স্টার ক্যার (খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৯০০০) এবং স্টোনহেঞ্জের কাছে ব্লিক মিড—এ দু’স্থানের অনুসন্ধানে কুকুরের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তৃণভূমিতে পশুপাল সামলানো, অরণ্যে হরিণ শিকার, আর শেষে সামষ্টিক আগুনের সামনে নিদ্রা—এই জীবনচক্রের সাথেই গড়ে ওঠে তাদের নিয়ে গল্পগাঁথা।
কাহিনি, গান, স্থানীয় গেজেট—সবখানেই ভৌতিক কুকুর। সাহিত্যে সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ শার্লক হোমসের ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’। অধিকাংশ ঘটনার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আজও অধরা।
অতিপ্রাকৃত কুকুরের নানা রূপ
কোথাও তারা নিবেদিত পোষ্য—মৃত মালিকের পথ ধরে অনন্তকাল পায়চারি করে। কোথাও অমঙ্গলের বার্তাবাহক। কোথাও অন্যায়, হিংস্র মৃত্যু বা সাংস্কৃতিক বৈষম্যের স্মারক। কেউ কেউ বলেন—এরা আদিম যুগের দূত, ‘সময়-ছিদ্র’ বা ‘পাতলা পর্দা’ ভেদ করে আসে। আর সন্দেহপ্রবণরা বলেন—মানুষ ‘গল্পবলি প্রাণী’, তাই গৃহস্থালির পুরনো সঙ্গী কুকুরকে গল্পে টেনে আনা স্বাভাবিক।
ব্রিটেনের অধিকাংশ ভৌতিক কুকুরই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক স্থানের সঙ্গে যুক্ত—গ্রাম্য রাস্তা, প্রাচীন শিবির, সমাধি ও কবরস্থান, ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও দুর্গ—যেখানে মানুষ-কুকুরের সম্পর্ক সময়ের পরতে পরতে লিখিত।
সড়কে ‘রোড রেজার’: অন্ধকার পথে জ্বলা চোখ
প্রাচীন পদচিহ্ন, সড়ক ও গলি—এসব পথ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে কালো কুকুরদের। ব্রিটেনে নথিভুক্ত অতিপ্রাকৃত কুকুর দেখার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এ শ্রেণির। এদের বেশিরভাগই বিশালদেহী, জ্বলন্ত চোখওয়ালা; কারও গলায় শিকল, কারও কথা বলার ক্ষমতা—সবাই ভয়ের প্রতীক।
ডার্টমুরের টাভিস্টক-ওকিহ্যাম্পটনের মাঝের পথে এক বিখ্যাত ঘটনা—লেডি হাওয়ার্ড রাতের আঁধারে তার ফিটজফোর্ড হাউস থেকে বেরোতেন মৃত স্বামীদের অস্থি দিয়ে বানানো এক ভুতুড়ে রথে, গন্তব্য ওকিহ্যাম্পটন ক্যাসল। সামনে দৌড়াত জ্বলজ্বলে চোখওয়ালা এক নরকীয় কুকুর। কখনও তিনি পথহারা যাত্রীকে তুলতেন—কিন্তু সেই লিফট বিপজ্জনক।
ডার্টমুরেই ‘উইস্টম্যানস উড’-এ শয়তানের খোঁয়াড়ে ‘উইশ্ট হাউন্ডস’—আর ইস্ট ডার্ট হোটেলের বাইরে রাত ৩টায় এক রক্তশিকারি কুকুর হাজির হয় নাকি; শতবর্ষ আগের পাপাচারী মদ্যপ খলাশির ডালা থেকে নর্দমায় ফেলা পানীয়ের গন্ধ পেয়ে সড়ক ধরে ক্ল্যাপার ব্রিজ পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়—চিরকালীন খোঁজে।
ডার্টমুর যেন ভৌতিক কুকুরদের আড্ডাখানা—উষর, নির্জন, ঘন জঙ্গল, খাঁজকাটা শিলা, জনহীন মোহনা—যেখানে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। ইয়র্কশায়ারের পশ্চিমে নির্জন সড়কে ‘জাইট্র্যাশ’—বিশাল কুকুরআত্মা; ইয়র্কশায়ার ডেলসে ‘বার্গেস্ট’—ভয়ংকর দাঁতনখওয়ালা শেয়াল-কুকুরসদৃশ আততায়ী। হুইটবির কাছে এক বার্গেস্ট নাকি শিকল টানত এবং উল্টো হেঁটে শূন্যে মিলিয়ে যেত। এরা অশুভ লক্ষণ, মৃত্যুবার্তা—তবে নদী পার হতে পারে না বলে কথা।
ওয়েলসে ‘কুন আনুন’—পাতালপুরীর ‘হাউন্ডস অফ দ্য আন্ডারওয়ার্ল্ড’—শেষকৃত্যের আগে কাতর স্বরে ডাকে। সাধারণত চোখ লালচে জ্বলন্ত; দেহরঙ এলাকা ভেদে নানা—বড় সাদা, ছোট লিভাররঙা, আবার কখনো রক্তে ভেজা লালচে। তারা কখনো দলে, কখনো একা ঘোরে; সঙ্গে থাকে পাতালপুরীর প্রভু ‘এরাউন’, ‘ওয়াইল্ড হান্ট’-এর নেতা। ত্রিমোহনায় ঘোরাঘুরি, কবরভূমি পছন্দ, পাহাড়ে বিচরণ—সবই তাদের স্বভাব।
এসব উদাহরণ মানুষের ‘বন্যতা’ সম্পর্কে দ্বৈত অনুভূতির কথা বলে। আজ আমরা বনস্নান, বন্য ক্যাম্পিং, আধুনিকতা থেকে পালানোর জন্য প্রকৃতিতে যাই; তবু—লুকিয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক ভয়, যখন নেকড়ে-ভালুক ছিল অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের অধিপতি। সেই বন্যতা ছিল বিশৃঙ্খলা, উন্মাদনা, শয়তানি—যেখানে ক্যানিস ফ্যামিলিয়ারিস আবার ক্যানিস লুপাসে রূপ নেয়—বিশ্বস্ত সহচর থেকে হিংস্র আক্রমণকারীতে।
সব কুকুরই রক্তপিপাসু নয়
ব্ল্যাক শাককে সাধারণত অমঙ্গলের দূত বলা হয়; তবু কখনো সে ফেনল্যান্ডের লোকদের কাছে ‘সহৃদয়’ মনে হয়েছে—বিশেষ করে নারীদের সাহায্য করেছে বলেও প্রচলন। সোমারসেটের কোয়ানটক পাহাড়ে ‘গার্ট ডগ’ ছিল একেবারে সহানুভূতিশীল—কুয়াশা ফুঁড়ে হারানো শিশুদের বাড়ি পৌঁছে দিত।
অমঙ্গল না সৌভাগ্য?
বাসযোগ্য প্রাসাদ-সম্পদেও আছে ভৌতিক কুকুর। কেন্টের লিডস ক্যাসলের চত্বরে নাকি দু’টি কালো কুকুর ঘোরে—কাকতালীয়ভাবে এ দুর্গেই আছে বিশ্বের বৃহত্তম কুকুরকলারের সংগ্রহ। এক কুকুর অমঙ্গলের লক্ষণ—ধরা হয়, ১৪৪০-এর দশকে হেনরি ষষ্ঠের ফুফু এলিয়েনর কপহ্যামকে ডাইনি সাব্যস্ত করে এখানে বন্দি করার পর সে দেখা দিতে শুরু করে। অন্যটি বরং সৌভাগ্যবান দূত—একবার নাকি একজন দর্শনার্থীকে জানালা থেকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকেও বাঁচায়, ঘেউঘেউ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দু’টিই কার্লি-কোটেড রিট্রিভারসদৃশ—ফলে দেখা হলে বুঝতে মুশকিল, অমঙ্গল না সৌভাগ্য।
লন্ডনের কুখ্যাত নিউগেট কারাগারে ‘ব্ল্যাক ডগ অব নিউগেট’-এর গল্প ১৫৯৬ সালের এক চাঞ্চল্যকর পুস্তিকায় বিখ্যাত হয়। হেনরি তৃতীয়ের আমলে নাকি বন্দীরা অত্যন্ত ক্ষুধায় সদ্য আনা এক পণ্ডিত-কারাবন্দীকে হত্যা করে ভক্ষণ করে। পরে সেই পণ্ডিতের ভূত এবং এক বিশাল কালো কুকুরের আত্মাও নাকি কারাগারে ঘুরে বেড়াতে থাকে—কেউ কুকুরটিকে দেখে ভয়ে মরে, কেউ তার ভয়ংকর চোয়ালের কামড়ে টুকরো টুকরো হয়; পালিয়ে গেলেও সে প্রতিশোধপরায়ণ জন্তু পিছু ছাড়ে না।
বন্ধু না শত্রু: কেন কুকুরই সবচেয়ে বেশি?
মানুষের সঙ্গে কুকুরের দীর্ঘ সহাবস্থানই এক কারণ—দ্বারপ্রান্তে নেকড়ের ছায়া টেনে আনে ‘বন্যতার’ ভয়। জীববিদ্যাগত কারণও আছে—অসাধারণ ইন্দ্রিয়ক্ষমতা। কুকুরের নাকে প্রায় ৩০ কোটি ঘ্রাণগ্রাহী; মানুষের ৫০–৬০ লাখের তুলনায় বহু গুণ। শ্রবণশক্তিও আমাদের থেকে অনেক উন্নত—তাই তাদের ক্ষমতা প্রায় ‘অতিপ্রাকৃত’ বলেই মনে হয়।
অতএব নানা সংস্কৃতির বিশ্বাসে কুকুরের বিশেষ স্থান। আজটেকদের ‘জোলোইৎসকুইন্টলি’ কুকুর নাকি ভূতের গন্ধ বুঝতে পারত—মালিককে রক্ষা করত। নর্স পুরাণে মৃত্যুসংলগ্ন দেবী ফ্রেয়া বিশাল বিড়ালজোড়া টানা রথে চড়তেন—তাই গৃহের কুকুর ঘেউঘেউ করে তার আগমন টের পেতে সাহায্য করত, সম্ভাব্য অনর্থ ঠেকাত। গ্রিক পুরাণে তিনমাথা কুকুর সের্বেরাস হেডিসের দ্বাররক্ষী—জীবন-মৃত্যুর সীমানা টহল দেয়।
আজও এসব বিশ্বাস টিকে আছে। ২০১৯ সালে ব্লু ক্রস প্রাণিবিষয়ক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে ৬৩ শতাংশ মালিক বলেছেন—তাদের পোষ্য নাকি ভূত বা অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি দেখেছে (অথবা দেখতে সক্ষম)। ভৌতিক কুকুরের কাহিনি আজও সমান জীবন্ত—প্রাচীন পদপথ ছাড়িয়ে আধুনিক হাইওয়ের উইন্ডস্ক্রিনের সামনেও তাদের দেখা মেলে।
ব্ল্যাক শাক: কিংবদন্তি থেকে উৎসব
১৫৭৭-এর বাংগের ‘শয়তানি’ আক্রমণ থেকেই ব্ল্যাক শাক পূর্ব অ্যাংলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫০ সালে ‘নোটস অ্যান্ড কোয়েরিস’-এ রেভারেন্ড ই. এস. টেলর লেখেন “শাক দ্য ডগ-ফিয়েন্ড”—পূর্ব নরফোক থেকে ক্যামব্রিজশায়ার পর্যন্ত বহু মানুষ নাকি মধ্যরাতে কবরস্থানে জ্বলন্ত চোখওয়ালা বিশাল কালো কুকুরকে দেখেছে।
অতিপ্রাকৃত অনুসন্ধানকারীরা দেখেছেন—শাক দেখার অধিকাংশ বয়ান ১৯০০ সালের পরের—অর্থাৎ আধুনিক যুগেই তার জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০২২ সালে বাংগেতে ‘ব্ল্যাক শাক ফেস্টিভ্যাল’ও শুরু হয়—শহরের ‘ভয়াল সত্তা’কে ঘিরে লোককথার নবজাগরণ।
সম্ভবত আজকের মেরুকৃত, টানাপোড়েনময় সমাজে এসব কাহিনির তাৎপর্য আরও বেড়েছে। এগুলো শেকড়ের কথা বলে—মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর পারস্পরিক ইতিহাসের স্মৃতি। আর মানুষের সৃষ্ট পরিবর্তন যখন প্রকৃতি ও সমাজকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন এ কাহিনিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রাকৃতিক (বা অতিপ্রাকৃতিক) জগতে আমরা যা জানি ও নিয়ন্ত্রণ করি তার সীমা আছে; সেই অজানার সামনে বিনয়ী হওয়াই শ্রেয়।