ক্যারিবীয় অঞ্চলে তিন দশকের বৃহত্তম সামরিক মোতায়েন
গত তিন দশকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে ব্যাপক সামরিক মোতায়েন চালিয়েছে। ১৯৮৯ সালে পানামা আক্রমণের পর এত বড় আকারে সামরিক উপস্থিতি আর দেখা যায়নি। এবারও এই শক্তিবৃদ্ধি এখানেই শেষ নয় বলে ইঙ্গিত মিলছে।
মাদুরো সরকার উৎখাতের গুঞ্জন
অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক তৎপরতা ঘিরে জল্পনা বাড়ছে যে, নিকোলাস মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওয়াশিংটন। আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ (পেন্টাগন) এ অঞ্চলে আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, এফ–৩৫বি যুদ্ধবিমান, এমকিউ–৯ রিপার ড্রোন, পি–৮ পোসাইডন নজরদারি বিমান এবং গোপন বিশেষ অভিযান জাহাজ পাঠিয়েছে।
এছাড়া মাদকপাচারকারী নৌযানগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে অন্তত ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ মঙ্গলবারের এক অভিযানে ছয়জন নিহত হয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এবার ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ এলাকাও হামলার লক্ষ্য হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েন করা শক্তি
যে সামরিক সরঞ্জামগুলো ক্যারিবীয় অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর অনেকই পূর্বে বড় সংঘাতে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে আছে ইউএসএস ইও জিমা (USS Iwo Jima)—একটি উভচর আক্রমণজাহাজ যা শত শত মেরিন বহন করতে সক্ষম। ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দাম হুসেনকে উৎখাতের অভিযানে এটি প্রথম অংশ নিয়েছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ ইউএসএস স্টকডেল (USS Stockdale)—যা ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় লোহিত সাগরে অভিযানে অংশ নিয়ে ‘সবচেয়ে যুদ্ধ অভিজ্ঞ’ জাহাজ হিসেবে পরিচিত।
মাদুরোর ওপর বাড়ছে চাপ
এই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ফলে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নতুন করে চাপে পড়েছেন। তিনি সম্ভাব্য যুক্তরাষ্ট্র হামলার আশঙ্কায় নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল’ নামের থিঙ্ক ট্যাংকের একজন বিশ্লেষক জিওফ র্যামসি বলেন, “হোয়াইট হাউস এখন স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মাদুরো সরকারের ভেতরের অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর এখনই উঠে দাঁড়ানোর সময়।”
মাদক পাচারের অভিযোগ
ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে, তারা ল্যাটিন আমেরিকার মাদকচক্রগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন পাচার করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-গামী বেশিরভাগ কোকেন কলম্বিয়া ও ইকুয়েডর থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পথ ধরে উত্তর দিকে আসে।
সম্ভাব্য অভিযান ও সেনা সংখ্যা
যদিও এই সামরিক উপস্থিতি নিয়ে মাদুরো বিরোধী অভিযান নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে, বর্তমান সৈন্যসংখ্যা মাত্র ১০,০০০ হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের সম্ভাবনা কম।
গত ৬০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র তিনবার ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছিল—
১৯৬৫ সালে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে, ১৯৮৩ সালে গ্রেনাডায় এবং ১৯৮৯ সালে পানামায় হামলা চালিয়েছিল। এসব অভিযানে কয়েক হাজার সৈন্য অংশ নিয়েছিল; পানামা অভিযানে প্রায় ২৭,০০০ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
ইরাকের সাদ্দাম হুসেনকে উৎখাত করতে ২০০৩ সালে প্রায় ১,৬০,০০০ মার্কিন সেনা অংশ নিয়েছিল। তুলনামূলকভাবে ভেনেজুয়েলা আকারে দ্বিগুণ বড়; পাহাড়, জঙ্গল ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরসমূহের কারণে এটি আরও জটিল ভূখণ্ড।
বিশেষ ইউনিটের সক্রিয় ভূমিকা
সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ২,২০০ সদস্যের একটি মেরিন এক্সপেডিশনারি ইউনিট ক্যারিবীয় সাগরে মোতায়েন রয়েছে, যারা সমুদ্র ও আকাশপথে আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম। বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ অভিযানের একটি ইউনিটও ভেনেজুয়েলার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে, যা স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, “বর্তমান বাহিনী আক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত নয়।” তাঁর হিসাব অনুযায়ী, পূর্ণমাত্রার আক্রমণের জন্য অন্তত ৫০,০০০ সেনা প্রয়োজন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতি একদিকে মাদুরো সরকারের ওপর কূটনৈতিক ও সামরিক চাপ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে অঞ্চলটিতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করছে। যদিও ওয়াশিংটন সরাসরি আক্রমণের সম্ভাবনা নাকচ করেনি, তবে এত বড় অভিযানের জন্য এখনও পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি।
# যুক্তরাষ্ট্র_ভেনেজুয়েলা_সং