হিমালয়ের বুকে ‘শতাব্দীর প্রকল্প’
তিব্বতের মেডগ কাউন্টির হিমালয়বেষ্টিত উপত্যকায় নির্মাণশ্রমিক, কর্মকর্তা ও তিব্বতি পোশাকে সজ্জিত স্থানীয় প্রশাসনিক নেতাদের সামনে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং তিন মাস আগে উদ্বোধন করেন এক ঐতিহাসিক প্রকল্প—বিশ্বের সবচেয়ে গভীর গিরিখাতে নির্মিতব্য ইয়ারলুং সাংপো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ১৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
লি চিয়াং বলেন, “এই প্রকল্প হবে বিশাল পরিসরের, দীর্ঘমেয়াদি এবং গভীর প্রভাববিস্তারকারী—নতুন যুগের প্রতীক হিসেবে এটি এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে উঠবে।” উদ্বোধনের সময় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা যায়, সারি সারি নীল এক্সকাভেটর নদীর ধারে খননকাজ শুরু করছে।
অর্থনৈতিক সংকটে আশা: কেন এখন এই প্রকল্প?
চীনের রিয়েল এস্টেট বাজারের পতন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের চাপ এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসে সৃষ্ট উৎপাদন উদ্বৃত্ত এখন অর্থনীতিতে মন্দা ও মূল্যপতনের (ডিফ্লেশন) ঝুঁকি তৈরি করেছে। শিল্পখাতে অনিশ্চয়তা বাড়ায় কর্মসংস্থান কমছে। ফলে ভোক্তা আস্থাও দুর্বল।
এ অবস্থায় জুলাইয়ে প্রকল্পটির ঘোষণা যেন সময়োচিত এক মনস্তাত্ত্বিক প্রণোদনা হয়ে আসে—অর্থনৈতিক আস্থা ফেরাতে।
আগামী সপ্তাহে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২৫–২০৩০) চূড়ান্ত করবে। সেখানে ‘স্বনির্ভরতা’ ও ‘সবুজ উন্নয়ন’কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে—দুটি দিকই প্রতিফলিত হয়েছে এই ইয়ারলুং সাংপো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাবে।
পশ্চিমাঞ্চলকে নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র বানানোর লক্ষ্য
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য লি দাওকুই বলেন, “আন্তর্জাতিক পরিবেশ ক্রমেই অস্থির হচ্ছে। তাই পশ্চিম চীনে এ ধরনের অবকাঠামো উদ্যোগ জাতীয় কৌশলের অংশ—যাতে পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোকে নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করা যায়।”
তিন গর্জ প্রকল্পের উত্তরসূরি
এই প্রকল্পকে অনেকে তুলনা করছেন নব্বইয়ের দশকের তিন গর্জ বাঁধের সঙ্গে, যা এশীয় আর্থিক সংকটের সময় নির্মিত হয়ে চীনের শিল্পবিপ্লবের প্রতীক হয়েছিল।
ইয়ারলুং সাংপো তার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বড় হবে, তবে আজকের চীনের অর্থনীতিও অনেক বড়। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এত বিশাল উদ্যোগও কি প্রবৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে পারবে, নাকি অবকাঠামো বিনিয়োগ এখন আর আগের মতো প্রভাব ফেলতে পারছে না?
কৌশলগত প্রভাব: ভারত ও বাংলাদেশে প্রভাব
এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্ব ভূরাজনৈতিক। কারণ ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে এই নদীর জল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন যদি নদীর উপরের অংশে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তবে তা আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রকল্পটি বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে—যা দেশের মোট আবাসিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের সমান। নির্মাণ ও পরিচালনায় এক লাখেরও বেশি লোক নিয়োগ পাবে, এবং প্রয়োজন হবে প্রায় চার কোটি টন সিমেন্ট ও ৪০ লাখ টন স্টিল।
বাঁধ নয়, সুড়ঙ্গপথে শক্তি উৎপাদন
তবে এটি ঐতিহ্যবাহী বাঁধ নয়। বরং হিমালয়ের নিচ দিয়ে কয়েকটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে নদীর কিছু প্রবাহকে নিচের দিকে শক্তি টারবাইনে চালানো হবে, তারপর তা পুনরায় মূল নদীতে ফিরে যাবে।
এই কঠিন ভূখণ্ডে উন্নত টানেল বোরিং প্রযুক্তি এবং অতিউচ্চ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে চীন।
প্রকল্প ঘোষণার পর থেকেই চীনের সিমেন্ট, স্টিল ও যন্ত্রপাতি কোম্পানির শেয়ারে উল্লম্ফন দেখা যায়, যা এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বাজার পুনরুদ্ধারে নতুন গতি আনে।
জাতীয় গর্বের প্রতীক থেকে অর্থনৈতিক আশার প্রতীক
চীনা বাজার বিশ্লেষক অ্যাম্বার ঝাং লেখেন, “তিন গর্জ বাঁধ শুধু প্রকৌশল বিস্ময়ই নয়, বরং জাতীয় গর্বের প্রতীক ও সমৃদ্ধির যুগের সূচক হয়ে উঠেছিল। ইয়ারলুং সাংপো প্রকল্প আরও বৃহৎ—তাই এটি নতুন ‘বৃদ্ধির চক্র’ শুরু করতে পারে, এমন প্রত্যাশা জাতীয় আবেগে পরিণত হয়েছে।”
হংকংয়ের বিনিয়োগ বিশ্লেষক হাও হং বলেন, “এটি আমেরিকার হুভার বাঁধের মতো, যা মহামন্দার সময় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক চাহিদা তৈরি করেছিল।”
অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পটি নির্মাণসামগ্রী—বিশেষ করে সিমেন্ট, স্টিল ও তামার দাম বাড়াবে, ফলে উৎপাদকরা আরও লাভবান হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।
তবে অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায় শেষে, চীনের বার্ষিক জিডিপিতে মাত্র ০.১ শতাংশ যোগ হবে—যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য খুবই সামান্য।
সুইস ব্যাংক লোমবার্ড ওডিয়েরের কৌশলবিদ হোমিন লি বলেন, “এটি কোনো গেম চেঞ্জার নয়।” আর ম্যাককুয়ারি গ্রুপের অর্থনীতিবিদ ল্যারি হু মন্তব্য করেন, “এ ধরনের মেগা ড্যাম নির্মাণ এখন আর মুদ্রাস্ফীতি বা প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের কার্যকর পথ নয়।”
পুরোনো সূত্রে ফেরার ইঙ্গিত?
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এটি চীনের সেই পুরোনো অভ্যাসেরই প্রতিফলন—অর্থনৈতিক মন্দার সময় বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি টানার চেষ্টা।
সুইস ব্যাংক জুলিয়াস বেয়ার-এর বিশ্লেষক কার্সটেন মেনকে লেখেন, “৪–৬ মিলিয়ন টন স্টিল ও ৩০–৫০ মিলিয়ন টন সিমেন্ট শুনতে বড় সংখ্যা, কিন্তু ১০ বছরের নির্মাণমেয়াদে এটি চীনের সামগ্রিক বাজারে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তাই প্রশ্ন থেকে যায়—যদি এত বিশাল প্রকল্পও অর্থনীতিতে গতি আনতে না পারে, তবে আর কী করতে পারবে?”
#চীন, ইয়ারলুং সাংপো, বাঁধ প্রকল্প, জলবিদ্যুৎ, হিমালয়, চীনা অর্থনীতি, অবকাঠামো, তিন গর্জ বাঁধ, লি চিয়াং, সারাক্ষণ রিপোর্ট