ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করে। এই সংঘাত দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৪ শতাংশ জুড়ে থাকা ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৭ অক্টোবর দিল্লিতে টাটা নেতৃত্বের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। আপাতত পরিস্থিতি শান্ত হলেও বিশ্লেষকদের মতে, এই বিরতি অস্থায়ী হতে পারে।
টাটা গ্রুপের কৌশলগত গুরুত্ব
চা থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর পর্যন্ত বিস্তৃত টাটা গ্রুপ ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। গ্রুপটি ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে দেশের প্রথম সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কারখানায়। এছাড়া এটি ভারতের একমাত্র আইফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সরকারি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে টাটার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
বিরোধের সূচনা ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
অক্টোবরের শুরুতে টাটা ট্রাস্ট, যা টাটা সন্সে ৬৬ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে, বোর্ডের এক সদস্য—প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব বিজয় সিংহ—এর পুনর্নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করলে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এই ঘটনাটি টাটা ও মিস্ত্রি পরিবারের বহু বছরের ক্ষমতার টানাপোড়েনকে সামনে আনে। এই মতবিরোধের ফলে ৩৬৮ বিলিয়ন ডলারের গ্রুপটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কর্পোরেট কাঠামোর জটিলতা
টাটা সন্সে কোনো বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত (১১ মিলিয়ন ডলারের বেশি) নিতে হলে টাটা ট্রাস্টের অনুমোদন প্রয়োজন। অন্যদিকে, শাপুরজি পালোনজি গ্রুপের হাতে রয়েছে ১৮.৪ শতাংশ শেয়ার, যা দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার। এই অনন্য কাঠামো যেখানে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণ করে, বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে পড়ে—যেমন মার্স্ক বা কার্লসবার্গ ফাউন্ডেশন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িক লাভকে কোনো পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত না করে সমাজকল্যাণে ব্যবহার করা।
ঐতিহাসিক টানাপোড়েন ও রতন টাটার পরবর্তী যুগ
২০১১ সালে রতন টাটা সাইরাস মিস্ত্রিকে চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন, যা ছিল পরিবারের বাইরের প্রথম নিয়োগ। কিন্তু ২০১৬ সালে তাঁর মেয়াদ অর্ধেক না কাটতেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ট্রাস্ট ও টাটা সন্সের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বাড়তে থাকে। রতন টাটার অবসরের পর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন তাঁর সৎভাই নোয়েল টাটা। বিশ্লেষক শ্রীরাম সুব্রহ্মনিয়ান বলেন, “এখন ট্রাস্টের মধ্যেই দুটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে—একটি মেহলি মিস্ত্রির নেতৃত্বে, অন্যটি রতন টাটার ঘনিষ্ঠদের।”
বোর্ডের ভেতরের ভোটাভুটি ও সরকারের সমাধান প্রচেষ্টা
সেপ্টেম্বরে ট্রাস্টের কিছু সদস্য বিজয় সিংহের পুনর্নিয়োগের বিপক্ষে ভোট দেন, আবার অন্যরা মেহলি মিস্ত্রির বোর্ডে যোগ দেওয়ার বিরোধিতা করেন। ৭ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পর ১০ অক্টোবরের বৈঠকে আপাতত সব দ্বন্দ্ব “চুপচাপ মিটে গেছে” বলে জানা যায়।
চন্দ্রশেখরনের মেয়াদ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
এই সংকটের মধ্যেও ট্রাস্ট টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এন. চন্দ্রশেখরনকে তৃতীয় মেয়াদের জন্য সুপারিশ করেছে। তবে শাপুরজি পালোনজি গ্রুপ ২০২২ সালে তাঁর পুনর্নিয়োগে ভোটদানে বিরত ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাস্টের ভেটো ক্ষমতা থাকায় ভবিষ্যতে বড় প্রকল্প—যেমন সেমিকন্ডাক্টর বা নতুন ব্যবসা স্থাপন—নিয়ে ফের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে।
শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির দাবি ও আর্থিক চাপে পালোনজি গ্রুপ
শাপুরজি পালোনজি গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে টাটা সন্সকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে, এবং তালিকাভুক্ত হলে তারা শেয়ার বিক্রি করে মূলধন ফেরত পাওয়ার সুযোগ পাবে। গ্রুপ চেয়ারম্যান শাপুরজি পালোনজি মিস্ত্রি একে “নৈতিক ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু টাটা ট্রাস্ট জানিয়েছে, তালিকাভুক্তি তাদের বিশেষ ভোটাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করবে, তাই তারা এই প্রস্তাবে রাজি নয়।
আরবিআইয়ের নির্দেশনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
২০২১ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) টাটা সন্সসহ ১৫টি বড় কর্পোরেটকে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য তালিকাভুক্ত হতে নির্দেশ দিয়েছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫–এর সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও টাটা সন্স তা পালন করেনি। কোম্পানিটি এখন “কোর ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি” হিসেবে নিজেদের নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করেছে, যাতে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা এড়ানো যায়। বিশ্লেষকদের মতে, “ভারতের অর্থনীতিতে টাটার বিশাল প্রভাবের কারণে আরবিআই তুলনামূলক নরম অবস্থান নিয়েছে।”
বর্তমানে আপাত শান্তি ফিরে এলেও টাটা ট্রাস্ট ও টাটা সন্সের দ্বন্দ্বের মূলে রয়ে গেছে কাঠামোগত ও ঐতিহাসিক জটিলতা। দেশীয় শিল্প ও সরকারের নীতি–নির্ধারণে টাটার ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারতের অর্থনীতি ও কর্পোরেট গভর্নেন্স—দুটিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।