ক্যারিবীয় সাগরে মার্কিন সামরিক হামলায় বেঁচে যাওয়া দুই সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত না রেখে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সিদ্ধান্তে ট্রাম্প প্রশাসন একটি বড় আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতা এড়াতে পেরেছে।
মাদকবিরোধী অভিযানের নতুন অধ্যায়
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে তথাকথিত ‘অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত’ বা সীমিত যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করে মাদকবিরোধী সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে মার্কিন বাহিনী একাধিক মাদকবাহী নৌযান ধ্বংস করেছে।
গত বৃহস্পতিবারের হামলায় একটি আধা-ডুবোজাহাজ লক্ষ্য করে আঘাত হানে মার্কিন বাহিনী। এই ধরনের জাহাজ পানির নিচ দিয়ে চলায় সেগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়, যা পাচারকারীদের জন্য সুবিধাজনক। হামলায় দুজন নিহত হলেও দুজন জীবিত উদ্ধার হন এবং মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে নেওয়া হয়।
‘যুদ্ধবন্দি’ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণ
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই দুই ব্যক্তিকে ‘যুদ্ধবন্দি’ ঘোষণা করলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে জটিল প্রশ্ন উঠত—কারণ এখানে কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ চলছে না।
দক্ষিণ-পশ্চিম ল’ স্কুলের অধ্যাপক ও সাবেক মার্কিন বিমানবাহিনীর আইন কর্মকর্তা র্যাচেল ভ্যানল্যান্ডিংহ্যাম বলেন, “যখন প্রকৃত কোনো সশস্ত্র সংঘাত নেই, তখন যুদ্ধ আইন অনুযায়ী কাউকে বন্দি রাখার কর্তৃত্বও থাকে না, চাই তাকে যা-ই বলা হোক।”
অন্য এক মার্কিন সামরিক আইনজীবী রয়টার্সকে জানান, এই বন্দিদের দীর্ঘমেয়াদি আটকের আইনি ভিত্তি আদালতে টেকানো কঠিন হতো। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসকে জানিয়েছে যে তারা “ড্রাগ কার্টেলদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক সশস্ত্র সংঘাতে” রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ আইনে স্বীকৃত নয়।
দ্রুত সিদ্ধান্ত: ফেরত পাঠানোই ‘সবচেয়ে কম খারাপ’ বিকল্প
হামলার পরের দিনই ট্রাম্প প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় বেঁচে যাওয়া দুজনকে দেশে ফেরত পাঠানোর। এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি দ্রুত পররাষ্ট্র দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা ব্রায়ান ফিনুকেন বলেন, “এটি ছিল প্রশাসনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে কম খারাপ বিকল্প। তাদের দেশে ফেরত পাঠানো আসলে এক অস্বস্তিকর অধ্যায় থেকে পৃষ্ঠা উল্টানোর প্রচেষ্টা।”
অন্য বিকল্প ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনের হাতে অন্য বিকল্পও ছিল—যেমন তাদের অবৈধ যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে কিউবার গুয়ানতানামো বেতে আটক রাখা বা যুক্তরাষ্ট্রে বিচার করা।
তবে এই পদক্ষেপ আইনি ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠত। বন্দিরা মার্কিন আইনের আওতায় নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারত, হেবিয়াস করপাসের মাধ্যমে আদালতে আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারত।
ফিনুকেন বলেন, আদালতে যেতে হলে প্রশাসনকে এমন প্রমাণ হাজির করতে হতো যা তাদের নিজস্ব বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করত এবং “এই হামলাগুলোর বিবরণকে দুর্বল করে দিত।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও তথ্যের অভাব
ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান জিম হাইমস বলেন, “ক্যারিবীয় সাগরে নৌযানগুলোর ওপর এই হামলা বেআইনি। যদি কোনো বন্দি আদালত বা সামরিক ট্রাইব্যুনালে হাজির হতো সেটি সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ হয়ে যেত।”
এ পর্যন্ত প্রশাসন হামলাগুলোর বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি—কত মাদক উদ্ধার হয়েছে বা কতজন নিহত হয়েছেন, তাও এখনো অজানা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানান, সর্বশেষ শুক্রবারের হামলায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: কলম্বিয়ার ক্ষোভ
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো অভিযোগ করেছেন, সেপ্টেম্বরের এক হামলায় যুক্তরাষ্ট্র আসলে মৎস্যজীবীদের নৌকা লক্ষ্য করে আঘাত হেনেছিল। এই অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প ও পেত্রোর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বাকযুদ্ধও শুরু হয়।
সামরিক না উপকূলরক্ষী বাহিনী?
আইন বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, মাদকবিরোধী অভিযানে কেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যখন এর দায়িত্ব মূলত কোস্ট গার্ডের। আরও প্রশ্ন উঠছে—মারাত্মক হামলার আগে পাচার ঠেকাতে বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া হলো না কেন।
মাদকবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা—সব ক্ষেত্রেই নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বন্দিদের দেশে ফেরত পাঠানো আপাতত একটি আইনি বিপদ এড়ানোর কৌশল হলেও, এই অভিযান ভবিষ্যতে মার্কিন নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পর্ক নিয়ে আরও প্রশ্ন তুলতে পারে।