এআই–এর যুগে ভারতের প্রযুক্তি খাতের রূপান্তর
বেঙ্গালুরুর এক স্টার্টআপ অফিসে তরুণ ডেভেলপাররা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট তৈরি করছেন, যারা মানুষের মতো কথা বলতে ও বার্তা পাঠাতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম “লাইমচ্যাট”। তাদের লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী— গ্রাহকসেবার মানবসম্পদকে প্রায় অচল করে দেওয়া। প্রতিষ্ঠানের দাবি, তাদের জেনারেটিভ এআই এজেন্ট ব্যবহার করলে মাসে ১০ হাজার গ্রাহক প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রয়োজনীয় কর্মীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিখিল গুপ্তা বলেন, “একবার লাইমচ্যাট এজেন্ট নিয়োগ দিলে, আবার কাউকে নিয়োগ দিতে হবে না।”
সস্তা শ্রম থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা — ভারতের আইটি বিপ্লবের নতুন ধারা
সস্তা শ্রমশক্তি ও ইংরেজি দক্ষতা একসময় ভারতকে বিশ্বের “ব্যাক অফিস” হিসেবে পরিচিত করেছিল। এখন সেই খাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ঢেউ তুলছে। কল সেন্টার, কাস্টমার কেয়ার ও ডেটা ব্যবস্থাপনার মতো কাজ দ্রুত স্বয়ংক্রিয় হয়ে পড়ছে, ফলে ভারতের ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের আইটি খাত এক আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এআই–নির্ভর স্টার্টআপগুলো কোম্পানিগুলোকে কর্মী ব্যয় কমাতে ও উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করছে, যদিও বহু গ্রাহক এখনো মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
ঝুঁকি নিয়েই এগোচ্ছে ভারত
চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকলেও ভারত সরকার প্রযুক্তি থামিয়ে রাখার পক্ষে নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফেব্রুয়ারিতে বলেন, “প্রযুক্তি কাজ কেড়ে নেয় না বরং কাজের ধরন বদলায় এবং নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে।”
কিন্তু বিশ্লেষক সন্তোষ মহারোত্র বলেন, সরকার এখনো তরুণ কর্মশক্তির ওপর এআই–এর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি। “কোনো কার্যকর পরিকল্পনাই নেই।”
বর্তমানে ভারতের বিজনেস প্রসেস ম্যানেজমেন্ট (বিপিএম) খাতে ১৬.৫ লাখ কর্মী নিয়োজিত। অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের কারণে নিয়োগ ব্যাপকভাবে কমেছে। গত দুই বছরে এই খাতে নিট কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১৭ হাজার, যেখানে ২০২১–২২ সালে ছিল ১.৭৭ লাখ।
চাকরি হারানোর বাস্তবতা
বেঙ্গালুরুর এক সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত মেঘা এস. সম্প্রতি চাকরি হারিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার জায়গায় এখন এআই এসেছে। আমি বাবা-মাকে এখনো বলিনি।”
জেফারিস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে কল সেন্টার খাতে আয়ের অর্ধেক পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে এআই – এর কারণে। অন্য ব্যাক-অফিস খাতেও প্রভাব পড়বে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

প্রমোদ ভাসিন, যিনি ১৯৯০-এর দশকে ভারতের প্রথম কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বলেন, “সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে সদ্য স্নাতক তরুণদের ওপর।” তবে দীর্ঘ মেয়াদে ভারত বিশ্বের “এআই ফ্যাক্টরি”তে পরিণত হতে পারে — যেখানে এআই প্রকৌশলী ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বাড়বে।
লাইমচ্যাটের উত্থান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা
লাইমচ্যাট ইতোমধ্যে ভারতজুড়ে পাঁচ হাজার কর্মস্থলের কাজ স্বয়ংক্রিয় করেছে। তাদের বটগুলো এখন ক্লায়েন্টদের ৭০ শতাংশ অভিযোগ নিজেরাই সমাধান করে এবং আগামী এক বছরের মধ্যে এই হার ৯৫ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে।
গুপ্তা বলেন, “যদি আমাদের প্রতি মাসে ১ লক্ষ রুপি দেন, আমরা অন্তত ১৫ কর্মীর কাজ স্বয়ংক্রিয় করতে পারি।”
লাইমচ্যাটের বিক্রি ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ ডলারে, যেখানে দুই বছর আগে ছিল মাত্র ৭৯ হাজার ডলার। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে রিলায়েন্সের মালিকানাধীন হ্যাপটিক, যা মানবসদৃশ এআই সেবা দিয়ে গ্রাহক সহায়তা ব্যয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পেরেছে।
‘মানব সংযোগ’ এখনো জরুরি
এআই গ্রহণের দৌড়ে সবাই সফল নয়। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনের ফিনটেক প্রতিষ্ঠান ক্লারনা হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছিল, কিন্তু এখন তাদের প্রধান নির্বাহী বলছেন — তারা ব্যয় কমানোর বদলে পণ্যের মান উন্নত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান।
২০২৪ সালের আগস্টে করা এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের ৬২ শতাংশ গ্রাহক এআই–এর পরামর্শে কেনাকাটা করেন, যদিও ৭৮ শতাংশ এখনো এমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পছন্দ করেন যেখানে মানব সহায়তা পাওয়া যায়।
নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষণ ও ভবিষ্যতের দিশা
১৯৯০-এর দশক থেকে ভারতের আইটি খাত গ্রামীণ–শহুরে অভিবাসন বাড়িয়েছে। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদসহ বড় শহরগুলো আউটসোর্সিং হাবে পরিণত হয়েছে। হায়দরাবাদের আমিরপেট অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো এখন প্রচলিত সফটওয়্যার কোর্সের পাশাপাশি এআই–ডেটা সায়েন্স ও প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করেছে।

একটি কেন্দ্রের কর্মী প্রিয়াঙ্কা কাণ্ডুলাপতি বলেন, “নিয়োগকারীরা এখন এআই–এর মৌলিক দক্ষতা খুঁজছেন। আমরা আমাদের কোর্সগুলো বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজিয়ে নিচ্ছি।”
ভেঞ্চার পুঁজিপতি বিনোদ খোসলা সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেন, “আগামী পাঁচ বছরে সব আইটি সেবা এআই–এ প্রতিস্থাপিত হবে। সময়টা বিশৃঙ্খল হবে, কিন্তু অনিবার্যও।”
ভারতের প্রযুক্তি খাত এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে — যেখানে প্রতিটি ঝুঁকি এক নতুন সম্ভাবনার দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে। এআই হয়তো লাখো চাকরি কেড়ে নেবে কিন্তু একই সঙ্গে সৃষ্টি করবে এমন এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা, যা শুধু ভারতের নয়, পুরো বিশ্বের জন্য একটি বাস্তব পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে।
# ভারত, #কৃত্রিম_বুদ্ধিমত্তা,# প্রযুক্তি_খাত, #এআই_বিপ্লব,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















