এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও, প্যারিস এখনো বহন করে সেই সৃষ্টিশীল উন্মাদের যুগের প্রতিধ্বনি। হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস, পিকাসো, জোসেফিন বেকার, ম্যান রে—তাদের পদচিহ্নে গড়া শহরটি আজও জীবন্ত ইতিহাসের মতো। ১৯২০-এর দশকের সেই হারানো প্রজন্মের শিল্প ও সাহিত্য আজও প্যারিসের রাস্তায়, ক্যাফেতে ও জাদুঘরে প্রতিধ্বনিত হয়।
প্যারিস: এক সৃজনশীল উত্তাল নগরী
টি.এস. এলিয়ট একবার লিখেছিলেন, “প্যারিসের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, এটি এমন এক তীব্র উদ্দীপক।” তাঁর মতোই সেই যুগের শিল্পীরা—জেমস জয়েস, সালভাদর দালি, ম্যান রে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড ও জেল্ডা ফিটজেরাল্ড—সবাই এই শহরের আবেশে মোহিত হয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯১৮ সালের মহামারির পর, আমেরিকার সংযমী সমাজ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে প্যারিসে এসে খুঁজে পেয়েছিলেন এক নতুন জীবন, যেখানে শিল্প, স্বাধীনতা ও আনন্দ একত্র হয়েছিল।

হারানো প্রজন্মের উত্থান
‘লস্ট জেনারেশন’ শব্দবন্ধটির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন লেখিকা গারট্রুড স্টাইন। এই প্রজন্মের শিল্পীরা ১৯২০-এর দশকের প্যারিসকে রূপ দিয়েছিলেন আধুনিক শিল্পের কেন্দ্রস্থলে। মনপারনাস ও মনমার্ত্র এলাকার ক্যাফে ও সেলুনে চলত সাহিত্য, কবিতা, সঙ্গীত ও চিত্রকলার নতুন সংলাপ।
হেমিংওয়ে ও জেমস জয়েস নিয়মিত মিলিত হতেন ‘শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি’ বইয়ের দোকানে, যা পরিচালনা করতেন আমেরিকান সিলভিয়া বিচ। তিনিই জয়েসের বিখ্যাত Ulysses প্রকাশ করেছিলেন—যা তৎকালীন ব্রিটেন ও আমেরিকায় নিষিদ্ধ ছিল।
হেমিংওয়ে: প্যারিসের আত্মা
১৯২১ সালে স্ত্রী হ্যাডলি রিচার্ডসনকে নিয়ে প্যারিসে আসার পর হেমিংওয়ে এই শহরকেই নিজের সাহিত্যিক ঘর বানান। এখানেই তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস The Sun Also Rises।
হেমিংওয়ে ছিলেন জোয়ান মিরোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু; তাঁর কাছ থেকে তিনি কিনেছিলেন চিত্রকর্ম The Farm। প্যারিসের বহু শিল্পীর মতো, হেমিংওয়েও দাদা–শিল্পধারায় মুগ্ধ হন। বর্তমানে প্যারিসের মিউজে দ’আর মডার্নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মার্সেল দুশঁ পুরস্কার প্রদর্শনী, যা সেই ঐতিহ্যেরই ধারক।
হেমিংওয়ের প্যারিস এখন পর্যটকদের জন্য এক সাহিত্যিক যাত্রাপথ—লেস দ্যু মাগো ও ক্যাফে দে ফ্লোর থেকে শুরু করে তাঁর প্রিয় ‘লা ক্লোজেরি দে লিলা’, যেখানে বসে তিনি লিখেছিলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা।
জোসেফিন বেকার: নৃত্যের বিপ্লবিনী
আমেরিকায় জন্ম নেওয়া জোসেফিন বেকার ১৯২৫ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্যারিসে আসেন। তাঁর মঞ্চনৃত্য, মুক্ত ভাবনা ও কালো শিল্পীদের প্রতিনিধিত্ব তাঁকে ইউরোপজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়।
২০২৫–২৬ মৌসুমে থিয়েত্র দে শঁজ এলিজে তাঁকে উৎসর্গ করে আয়োজন করছে একাধিক অনুষ্ঠান, এবং তাঁর জীবনীভিত্তিক Josephine Baker: The Musical নাটকটি আবারও মঞ্চস্থ হচ্ছে।
বেকার ছিলেন শুধু নৃত্যশিল্পী নন—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। ২০২১ সালে তাঁকে ফ্রান্সের প্যানথেয়নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, জাতির নায়িকা হিসেবে।

পিকাসো: প্যারিসের চিরন্তন শিল্পী
স্প্যানিশ শিল্পী পাবলো পিকাসো ১৯০৪ সালে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মনপারনাস ও মনমার্ত্র তাঁকে দিয়েছিল এক নতুন সৃজনজগত। তাঁর বিখ্যাত ‘বাতো লাভোয়ার’ স্টুডিও আজও শিল্পপ্রেমীদের জন্য এক প্রতীকী স্থাপনা।
বর্তমানে মিউজে পিকাসো প্যারিসে চলছে তাঁর স্থায়ী প্রদর্শনী La Collection: Picasso Revoir, যা ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত চলবে।
ম্যান রে: ক্যামেরায় বন্দি প্যারিসের আত্মা
আমেরিকান শিল্পী ম্যান রে প্রায় চার দশক প্যারিসে বসবাস করেন। সাদা-কালো আলোকচিত্রে তিনি ধরে রেখেছেন সেই সময়ের মানুষের জীবন ও শহরের নান্দনিক ছন্দ।
এ বছর তাঁর কাজ নিয়ে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম ও মিলানের পালাজ্জো রেয়ালে দুটি প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি, প্যারিসের গ্যালেরি ইভা মায়ারেও চলছে তাঁর প্রিন্ট প্রদর্শনী।

আজকের প্যারিসে সেই উত্তরাধিকার
লুক্সেমবার্গ গার্ডেনে বসে কেউ এখনো কল্পনা করতে পারে—হেমিংওয়ে, স্টাইন, টোকলাস, জয়েস বা বেকার হাঁটছেন শরতের পাতাঝরা পথে, একসময়ের স্বপ্নময় যুগের প্রতিচ্ছবি হয়ে।
১৯২৯ সালের মহামন্দা ও ১৯৩০-এর দশকের ফ্যাসিবাদী উত্থান সেই স্বর্ণযুগের অবসান ঘটালেও, তাদের আত্মা আজও প্যারিসের রাস্তায় ভাসে।
আর্ট বাসেল প্যারিস কিংবা শহরের শত শত ক্যাফে—সবই যেন আজও ফিসফিস করে বলে, “প্যারিস এক সময় শুধু একটি শহর ছিল না, ছিল এক অনির্বচনীয় অনুভূতির নাম।”
#প্যারিস,# হারানো_#প্রজন্ম,# হেমিংওয়ে, #পিকাসো,# জোসেফিন_#বেকার, ম্যান_রে, #আর্ট_বাসেল_#প্যারিস,# সাহিত্য_ও_শিল্প,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















