প্যারিসের ফিলহারমনি দ্য প্যারিসের মিউজে দ্য লা মিউজিক-এ শুরু হয়েছে এক অনন্য প্রদর্শনী—‘কান্দিনস্কি: দ্য মিউজিক অব কালার্স’। এই প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা শুধু ওয়াসিলি কান্দিনস্কির চিত্র দেখবেন না, বরং ‘শুনবেন’ও তাঁর শিল্পকর্মকে—সুর, রঙ ও অনুভূতির এক সঙ্গীতধর্মী সংলাপে।
সুর থেকে রঙে: কান্দিনস্কির অনুপ্রেরণা
১৮৯৬ সালে মস্কোর বোলশই থিয়েটারে রিচার্ড ওয়াগনারের অপেরা ‘লোহেনগ্রিন’-এর একটি প্রদর্শনী দেখে ৩০ বছর বয়সী কান্দিনস্কির জীবনই বদলে যায়।
তিনি বলেন, “আমার চোখের সামনে যেন সব রঙ জীবন্ত হয়ে উঠল, বুনো, পাগলাটে রেখাগুলো নাচতে লাগল — তখনই বুঝেছিলাম, চিত্রকলাও সঙ্গীতের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।”

সেই বছরই তিনি রাশিয়া ছেড়ে জার্মানির মিউনিখে যান, চিত্রকলায় পড়াশোনা শুরু করতে। পরবর্তীতে এই অভিজ্ঞতাই তাঁর শিল্পজীবনের দিকনির্দেশনা হয়ে ওঠে — চিত্র ও সঙ্গীতের সীমা ভেঙে বিমূর্ততার নতুন ভাষা গড়ে তোলেন তিনি।
প্রদর্শনীর প্রেক্ষাপট ও আয়োজন
‘কান্দিনস্কি: দ্য মিউজিক অব কালার্স’ প্রদর্শনীটি ২০২৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে প্যারিসের পম্পিদু সেন্টার ও মিউজে দ্য লা মিউজিক। প্রায় ২০০টি শিল্পকর্ম ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ এখানে প্রদর্শিত হয়েছে, যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পম্পিদু সেন্টারের বিশাল কান্দিনস্কি সংরক্ষণাগার থেকে এসেছে।
বর্তমানে পম্পিদু সেন্টার সংস্কারের কারণে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে; তাই এই সময়কালে তারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী করছে—এই আয়োজনও তারই অংশ।
সুর ও শিল্পের সংলাপ
মিউজে দ্য লা মিউজিকের পরিচালক মারি-পলিন মার্টিন বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র শিল্পীর জীবনী উপস্থাপন নয়, বরং সঙ্গীত ও দৃশ্যশিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান করা।”
এই প্রদর্শনীর অন্যতম উৎস ছিল কান্দিনস্কির পম্পিদুতে সংরক্ষিত আর্কাইভ, যেখানে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নিনার দান করা ৯৫টি শেলাক রেকর্ডও অন্তর্ভুক্ত।

কিউরেটর অ্যাঞ্জেলা ল্যাম্পে ও পিয়ানিস্ট মিখাইল রুডির সহযোগিতায় দর্শকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এক অনন্য শব্দানুভূতির ব্যবস্থা—জিওলোকেটেড হেডফোন পরা দর্শকরা যখন গ্যালারিতে হাঁটবেন, তখন তাঁদের কানে ভেসে আসবে ওয়াগনারের ‘লোহেনগ্রিন’ থেকে রুশ অর্থোডক্স সঙ্গীত পর্যন্ত বিভিন্ন সুর, যা কান্দিনস্কির শিল্পচিন্তার প্রতিফলন।
সঙ্গীতের প্রভাব ও শিল্পতত্ত্ব
প্রদর্শনীর ১২টি থিম্যাটিক বিভাগে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে সঙ্গীত কান্দিনস্কির তত্ত্ব ও চিত্রকলায় প্রভাব ফেলেছিল। ব্লু রাইডার (Der Blaue Reiter) আন্দোলন থেকে শুরু করে বাউহাউস স্কুলে তাঁর শিক্ষকতা—সব পর্যায়েই সুর ও রঙের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর গভীর গবেষণা প্রতিফলিত হয়েছে।
তাঁর বিখ্যাত চিত্র ‘ইমপ্রেশন III (কনসার্ট)’ (১৯১১) ছিল আরনল্ড শোয়েনবার্গের এক সঙ্গীতানুষ্ঠান থেকে অনুপ্রাণিত। এই চিত্রে রঙ ও ছন্দের বিন্যাস সঙ্গীতের তাল ও স্বরের অনুরণন সৃষ্টি করে।
শোয়েনবার্গ পরে লিখেছিলেন, “কান্দিনস্কি তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যারা বাইরের বস্তু নয়, বরং রঙ ও আকার দিয়ে অভ্যন্তরীণ সুরকে চিত্রিত করেন।”
সংগীত ও শিল্পের মিলন: আর্কাইভ থেকে মঞ্চে
কান্দিনস্কির সংরক্ষণাগারে পাওয়া ২০টি রেকর্ডে তাঁর বিচিত্র সঙ্গীতরুচি ধরা পড়ে—বাখ থেকে স্ট্রাভিনস্কি, কার্ট ওয়েইলের ‘থ্রিপেনি অপেরা’ থেকে ১৯২০ দশকের নৃত্যসঙ্গীত পর্যন্ত।
এখানে পুনর্গঠন করা হয়েছে ১৯২৮ সালে জার্মানির দেসাও-তে তাঁর মঞ্চনির্দেশিত মুসর্গস্কির ‘পিকচার্স অ্যাট অ্যান এক্সিবিশন’-এর সেট ডিজাইন, যা ছিল তাঁর একমাত্র পরিচালিত সঙ্গীতনাট্য।
কান্দিনস্কি প্রায়ই তাঁর চিত্রের নাম রাখতেন ‘ইমপ্রোভাইজেশন’, ‘ফিউগ’, ‘সং’; কিন্তু তাঁর সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী দশটি চিত্রের নাম ছিল ‘কম্পোজিশন’।

প্রদর্শনীর পরিসমাপ্তি
প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে তিনটি বিশাল ক্যানভাস দিয়ে—‘কম্পোজিশন ৮’ (১৯২৩, গুগেনহেইম মিউজিয়াম, নিউইয়র্ক), ‘কম্পোজিশন ৯’ (১৯৩৬, পম্পিদু সেন্টার), এবং ‘কম্পোজিশন ১০’ (১৯৩৯, ডুসেলডর্ফের কুনস্টসমলুং নর্থরাইন ওয়েস্টফালেন)।
কিউরেটর ল্যাম্পে বলেন, “এই সমাপ্তি সেই ধারণাকেই প্রতিফলিত করে যা কান্দিনস্কিকে চালিত করেছিল—চিত্রকলাকে বিমূর্ততার সর্বোচ্চ শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠা করা, ঠিক যেমন সঙ্গীত।”
‘দ্য মিউজিক অব কালার্স’ প্রদর্শনী কেবল কান্দিনস্কির শিল্প নয়, তাঁর চিন্তাধারারও এক জীবন্ত প্রতিধ্বনি—যেখানে রঙ গেয়ে ওঠে, আর সুর রূপ নেয় রেখায়।
#কান্দিনস্কি #প্যারিস #শিল্পপ্রদর্শনী #বিমূর্তশিল্প #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















