রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানি—রসনেফট ও লুকওইল—এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাতে মস্কোর অর্থ জোগান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে ট্রাম্প কতদূর পর্যন্ত এটি বাস্তবায়নে প্রস্তুত—এবং তিনি কি জ্বালানির দামের সম্ভাব্য বৃদ্ধি সহ্য করতে পারবেন কি না, তার ওপর।
রাশিয়ার তেল কোম্পানির ওপর আঘাত
রসনেফট ও লুকওইল বিশ্ববাজারের মোট সরবরাহের প্রায় ৫ শতাংশ বা দৈনিক ৫.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খবর প্রকাশের পর বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম ৫ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যায়।
নতুন নিষেধাজ্ঞা কোম্পানিগুলোকে ডলার-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে ঠেলে দিয়েছে, যা আগেই ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, রুশ কোম্পানিগুলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে “শ্যাডো ফ্লিট” বা ছায়া জাহাজ ব্যবস্থার মতো বিকল্প পদ্ধতি গড়ে তুলেছে। ফলে ২০২২ সালে প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে রপ্তানি সামান্য কমে ২০২৪ সালে ৭.৫ মিলিয়ন ব্যারেলে নেমে এলেও তা উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।

দ্বিতীয়িক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি
নতুন মার্কিন পদক্ষেপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এখন যেকোনো বিদেশি কোম্পানি যদি রসনেফট বা লুকওইলের সঙ্গে লেনদেন করে, তবে তারাও মার্কিন দ্বিতীয়িক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে।
মূল প্রশ্ন হলো—রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই ক্রেতা ভারত ও চীন এই পরিস্থিতিতে কী করবে, এবং তারা যদি নিষেধাজ্ঞা মানতে না চায়, ট্রাম্প কতটা চাপ প্রয়োগ করবেন।
ভারতের অবস্থান: চাপের মুখে সমন্বয়
২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ভারত দৈনিক ১.৯ মিলিয়ন ব্যারেল রুশ তেল কিনেছে, যা রাশিয়ার মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ। রসনেফট ভারতের বাদিনার রিফাইনারিতে ৪৯ শতাংশ মালিকানা রাখে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাবের বিনিময়ে রুশ তেল আমদানি হ্রাসের চাপ দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, ভারত নিজস্ব রিফাইনিং শিল্পের ক্ষতি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমাতে পারে। তুরস্ক, তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা দেশটি, একইভাবে ক্রয় স্থগিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনের প্রতিক্রিয়া হবে প্রধান পরীক্ষা
চীন বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রেতা—জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দৈনিক ২.১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছে, যা তার মোট আমদানির ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ আসে রসনেফট-নিয়ন্ত্রিত ইএসপিও পাইপলাইন দিয়ে।
চীন প্রাথমিকভাবে কিছুটা আমদানি কমাতে পারে, বিশেষত যদি দাম বাড়তে থাকে। তবে বেইজিং অতীতে যেমন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে, এবারও তারা কতটা সহযোগিতা করবে তা অনিশ্চিত।
ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত চীনের ওপর কঠোর চাপ দেননি, যদিও কিছু ছোট চীনা রিফাইনারির ওপর শাস্তি দিয়েছে ওয়াশিংটন। যদি এবার বড় চীনা কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তাহলে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে বেইজিং, যা চলমান বাণিজ্য আলোচনাকে আরও জটিল করবে।

তেলের অতিরিক্ত সরবরাহ: ট্রাম্পের পক্ষে অনুকূল সময়
তেলের দামে হঠাৎ বৃদ্ধি মার্কিন জনগণের কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয় হবে। তবে বাজারে বর্তমানে সরবরাহ উদ্বৃত্ত থাকায় ট্রাম্পের জন্য সময়টি অনুকূল।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) জানিয়েছে, ২০২৫ সালে দৈনিক ২.৩৫ মিলিয়ন ব্যারেল এবং ২০২৬ সালে প্রায় ৪ মিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত সরবরাহ থাকবে। ফলে ভারত ও চীন যদি রুশ তেল আমদানি কমায়, তবু বিকল্প উৎস থেকে কিছুটা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক চাপ না রাজনৈতিক বাজি?
রাশিয়া বৈশ্বিক তেলবাজারের অন্যতম প্রধান শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র যদি দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার রপ্তানি সীমিত করে, তবে তেলের দাম বাড়া এবং বাজারে অস্থিরতা অনিবার্য হবে—যা ট্রাম্প এড়িয়ে যেতে চাইবেন।
তবে তিনি হয়তো বাজি ধরেছেন—অর্থনৈতিক চাপের ভয়েই পুতিন দ্রুত আলোচনার টেবিলে ফিরবেন। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প কি এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত—এবং চীনকে ক্ষুব্ধ করার মূল্য দিতে রাজি?
রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা শুধু যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর নয়, বিশ্ব জ্বালানি বাজারেও বড় প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এখন শুধু রাশিয়ার নয়—চীন, ভারত ও বৈশ্বিক বাজারের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে।
#
যুক্তরাষ্ট্র | রাশিয়া | তেল নিষেধাজ্ঞা | ট্রাম্প | ইউক্রেন যুদ্ধ | জ্বালানি বাজার | চীন | ভারত | রসনেফট | লুকওইল
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















