মালয়েশিয়া এই সপ্তাহান্তে আয়োজন করছে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী আসিয়ান সম্মেলন, যেখানে অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বের শীর্ষ নেতারা। বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনাই হবে এ তিন দিনের সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
ট্রাম্পের আগমন: কূটনৈতিক উত্তেজনা ও প্রত্যাশা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রবিবার সকালে এয়ার ফোর্স ওয়ানে কুয়ালালামপুরে পৌঁছাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর তিনি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া-সহ এশিয়া সফর শুরু করবেন। তার আগে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ও বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী হে লিফেংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন সাম্প্রতিক বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে।
আসিয়ান দেশগুলো ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বক্তব্য ও আচরণ নিয়ে সতর্ক, বিশেষ করে চীনকে নিয়ে তার মন্তব্যগুলো নিয়ে। যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন তিনি “চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চান”, তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাটিতে কোনো তীব্র চীনবিরোধী মন্তব্য মালয়েশিয়া ও পুরো আসিয়ান জোটকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক সাক্ষাৎ ও সম্ভাব্য চুক্তি
সম্মেলনের ফাঁকে ট্রাম্পের একাধিক বৈঠক নির্ধারিত আছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় হবে শুল্কবৃদ্ধি নিয়ে সাম্প্রতিক বিরোধ।
এছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে ট্রাম্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে, যেখানে প্রায় ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা, জ্বালানি ও বিমানপণ্য ক্রয় এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।
আসিয়ান ও আঞ্চলিক বাণিজ্য কাঠামো (RCEP)
আসিয়ান নেতারা ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সংহতি জোরদার করার দিকেও জোর দিচ্ছেন। আনোয়ার ইব্রাহিম আসিয়ানকে একটি একীভূত বাজার হিসেবে উপস্থাপন করতে চান—যেখানে ৬৮ কোটি মানুষের তরুণ জনসংখ্যা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে।
আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামো RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership)-এর অগ্রগতি পুনরায় শুরু করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলসহ উদীয়মান অর্থনীতির ব্লক BRICS-এর নেতারা আলোচনায় অংশ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা ইস্যু ও সাইবার প্রতারণা মোকাবিলা
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিপরীতে আসিয়ান দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা অঙ্গীকার পুনরায় নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেট জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তবে এর বিনিময়ে সদস্য দেশগুলোকে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম কেনার শর্তও থাকতে পারে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় বিষয় হয়ে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পরিচালিত প্রতারণা চক্র। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিটকয়েন জব্দ করেছে এবং কম্বোডিয়ার প্রিন্স গ্রুপের প্রধানের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক শ্রম শিবির থেকে পরিচালিত ক্রিপ্টো প্রতারণার অভিযোগ এনেছে।
এই প্রেক্ষাপটে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনকে দায়ী করে নতুন আঞ্চলিক উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
মিয়ানমারের শূন্য আসন ও নতুন সদস্য পূর্ব তিমুর
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এবারও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে না। সংগঠনটি মিয়ানমারের প্রস্তাবিত ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বৈধতা না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছে।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাসান জানিয়েছেন, তিনি মিয়ানমারের সেনা সরকারের প্রতিনিধি ও বিরোধী পক্ষের সঙ্গে এক বৈঠক করে ফলাফলটি আসিয়ান নেতাদের সঙ্গে ভাগ করবেন।
অন্যদিকে পূর্ব তিমুরকে এই বছর আনুষ্ঠানিকভাবে আসিয়ানের একাদশ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এতে জোটের সামুদ্রিক পরিসর ও অর্থনৈতিক ওজন আরও বাড়বে।
কুয়ালালামপুর সম্মেলনটি আসিয়ান অঞ্চলের জন্য কেবল একটি কূটনৈতিক আয়োজন নয়, বরং এটি এশিয়া ও বিশ্বের নতুন শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ট্রাম্পের অবস্থান, চীনের প্রতিক্রিয়া এবং সদস্য দেশগুলোর ঐক্য—সবকিছু মিলেই নির্ধারণ করবে আসিয়ানের ভবিষ্যৎ কৌশলগত দিকনির্দেশনা।
#আসিয়ান_সম্মেলন, ট্রাম্প, মালয়েশিয়া, বাণিজ্য_নীতি, চীন_যুক্তরাষ্ট্র_সম্পর্ক, দক্ষিণ_চীন_সাগর, RCEP, মিয়ানমার, পূর্ব_তিমুর, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















