টেল এস-সাকান ( ‘ছাইয়ের টিলা’) গাজা নগরীর দক্ষিণে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক প্রত্নস্থল, যা ফিলিস্তিনের অন্যতম প্রাচীন নগর সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। এটি একাধিক প্রাচীন বসতির স্তর জমে তৈরি হওয়া একটি টিলা, যার বয়স আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ২২৫০ সালের মধ্যে। এখানে একসময় প্রাচীন মিশরীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র ও পরবর্তীতে কেনানীয় নগর রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
নগর গঠনের ধারাবাহিকতা
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয়দের দক্ষিণ কানান-অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারের সময় এই নগরটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। প্রথম পর্যায়ে এটি ছিল একটি মিশরীয় দুর্গনগর—মাটির ইটের দেয়াল ও কেল্লা দ্বারা সুরক্ষিত। পরে এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে কিছু সময় পরিত্যক্ত হয়। এরপর, প্রায় চার শতাব্দী পরে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ সালে কেনানীয়রা এখানে নতুন এক নগর গড়ে তোলে, যা ২২৫০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত টিকে ছিল। এরপর টেল এস-সাকান সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়।
প্রাচীন মিশরীয় পর্যায় (৩৩০০–৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব)
প্রথম বসতি ছিল মিশরীয়দের প্রশাসনিক উপনিবেশ। প্রত্নতত্ত্ববিদ পিয়ের দে মিরোশেদজি (Pierre de Miroschedji) ও মুয়াইন সাদেকের নেতৃত্বে খননে পাওয়া গেছে মাটির ইটের বাড়ি, শস্যভাণ্ডার, প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও মিশরীয় ঢঙের মৃৎপাত্র।

প্রথমে বসতি ছিল অরক্ষিত, পরে চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। প্রাচীরের পুরুত্ব প্রথমে ছিল ১.৫ মিটার, পরে বাড়িয়ে ৩.৮ মিটার করা হয়। মিশরীয় সময়ের মৃৎপাত্রে রাজাদের নাম খোদাই করা প্রতীক বা ‘সেরেখ’ পাওয়া গেছে, যেগুলোর একটি সম্ভবত প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ফেরাউন নারমারের।
এই সময়ের খাদ্যতালিকায় ছিল গম, যব, ডাল, ডুমুর ও আঙ্গুর; গবাদিপশুর মধ্যে ছিল ছাগল, ভেড়া, গরু ও শূকর। এছাড়া এখানে মিশরীয় দেবী হেকেতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ব্যাঙ-আকৃতির চুনাপাথরের একটি ভাস্কর্যও পাওয়া যায়।
কেনানীয় পর্যায় (২৬০০–২২৫০ খ্রিষ্টপূর্ব)
মিশরীয় শাসন শেষে শতাধিক বছর পর কেনানীয়রা টেল এস-সাকানে ফিরে আসে। তারা এখানে একটি বৃহৎ দেয়ালঘেরা নগর গড়ে তোলে—যার প্রাচীরের পুরুত্ব ছিল প্রায় ৭.৮ মিটার, অর্থাৎ মিশরীয় দুর্গের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। বাড়িগুলো ছিল চুন-সাদা রঙে মোছা দেয়ালে গঠিত, বহু ঘর একে অপরের ওপর নির্মিত হওয়ায় নগরজীবনের উন্নততা বোঝা যায়।
এই পর্যায়ে শূকর মাংসের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়, যা সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে ধারণা করা হয়, ফেরাউন পেপি প্রথমের আমলে মিশরীয় গভর্নর উনি এই নগরে হামলা চালিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত, খ্রিষ্টপূর্ব ২২৫০ সালের দিকে নদীপথ পরিবর্তন ও জলসম্পদ সংকটের জন্য নগরটি পরিত্যক্ত হয়, এবং কিছু দূরে ‘টেল এল-আজজুল’ নামে নতুন নগর গড়ে ওঠে।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও গবেষণা
১৯৯৮ সালে গাজা নগরের এক নির্মাণ প্রকল্পের সময় অপ্রত্যাশিতভাবে টেল এস-সাকান আবিষ্কৃত হয়। পরের বছর ফিলিস্তিনের প্রাচীনত্ব দপ্তর ও ফরাসি ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ যৌথভাবে এখানে উদ্ধার অভিযান চালায়। খননে পাওয়া যায় প্রায় ৯ মিটার গভীর প্রত্নস্তর, যা গাজা উপত্যকার প্রাচীনতম নগর হিসেবে প্রমাণিত হয়।
খননের সময় প্রচুর ছাই পাওয়া যাওয়ায় এই টিলার নাম হয় “টেল এস-সাকান”—অর্থাৎ “ছাইয়ের পাহাড়”। পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয়, এটি ছিল নীলনদের বাইরে মিশরীয়দের সবচেয়ে পুরোনো দুর্গনগর।
ধ্বংস ও সংরক্ষণ সংকট
২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলে গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে গাজার হামাস সরকারের ভূমি কর্তৃপক্ষ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য টিলার একাংশ বুলডোজ করে, যা দেশি-বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিকদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে থেমে যায়। ইউনেস্কো এ ঘটনাকে “ফিলিস্তিনের প্রত্নঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয়কর” বলে মন্তব্য করে।
২০২৩–২৫ সালের ইসরায়েলি আগ্রাসনে টেল এস-সাকানসহ গাজার শতাধিক প্রত্নস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপগ্রহচিত্রে দেখা যায়, টিলার পূর্ব কোণ বুলডোজারে সমতল করা হয়েছে।
তবে ২০২৫ সালে প্যারিসের Institut du Monde Arabe–এ “Saved Treasures of Gaza: 5000 Years of History” প্রদর্শনীতে টেল এস-সাকানের কিছু উদ্ধারকৃত নিদর্শন পুনরায় প্রদর্শিত হয়। একই বছর ইতালীয় সুরকার দাভিদে ভেরোত্তা এই প্রত্ননগরের নামে একটি সংগীত রচনা করেন—গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে।
টেল এস-সাকান আজ ধ্বংসপ্রায় হলেও এটি প্রমাণ করে যে গাজা উপত্যকা একসময়ে মিশরীয় ও কেনানীয় সভ্যতার সংযোগস্থল ছিল। প্রশাসনিক কেন্দ্র, বাণিজ্যবন্দর ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন হিসেবে এই নগর প্রাচীন লেভান্ট অঞ্চলের ইতিহাসে অনন্য। এর সংরক্ষণ এখন শুধু প্রত্নতত্ত্ব নয়, ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নও বোধগম্যভাবে উঠে আসে।
#গাজা_উপত্যকা, প্রাচীন_মিশর, কেনানীয়_সভ্যতা, প্রত্নতত্ত্ব, ইউনেস্কো, টেল_এস_সাকান, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















