তাইওয়ান উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে চীনের নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, যা সম্ভবত দেশটির নিয়ন্ত্রণাধীন সংবেদনশীল সীমান্তবর্তী দ্বীপগুলো — বিশেষ করে কিনমেন — অন্তর্ভুক্ত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি তাইওয়ানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
চীনের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তাইওয়ানের উদ্বেগ
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বর্তমানে আলোচনা চলছে দেশের পনেরোতম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে, যা আগামী বছর আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হবে এবং মার্চ মাসে জাতীয় গণপরিষদের অধিবেশনে প্রকাশিত হবে।
তাইওয়ানের কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বেইজিং যদি এই পরিকল্পনায় কিনমেনসহ তাইওয়ান নিয়ন্ত্রিত দ্বীপগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক একীকরণের উল্লেখ করে, তাহলে সেটি এক ধরনের প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হবে।
‘গাজর-লাঠি’ নীতি: চীনের দ্বৈত কৌশল
চীন দীর্ঘদিন ধরে কিনমেনকে প্রলুব্ধ ও চাপের মধ্যে রাখার কৌশল নিয়েছে। একদিকে কোস্টগার্ডের টহল ও জাহাজ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ভয় দেখানো, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রলোভন দিয়ে দ্বীপের প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার বাসিন্দাকে কাছে টানার চেষ্টা করছে।

কিনমেনের ভৌগোলিক অবস্থান — চীনের শিয়ামেন শহর থেকে সামান্য নৌপথ দূরত্ব — এটিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
স্থানীয় সম্পর্ক ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা
তাইওয়ানের কুওমিনতাং (কেএমটি) দলের নেতৃত্বে থাকা পূর্ববর্তী সরকার চীনের সঙ্গে পানির সরবরাহ চুক্তি করেছিল, যা আজও বহাল আছে। অনেক কিনমেনবাসীর ব্যবসা ও পারিবারিক যোগাযোগ রয়েছে চীনের সঙ্গে, ফলে বেইজিংয়ের আর্থিক প্রলোভন তাদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।
তবে তাইওয়ান প্রশাসনের আশঙ্কা — এই অর্থনৈতিক নির্ভরতা যদি বেইজিংয়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে সেটি কার্যত চীনের ‘অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠার পথে একটি পদক্ষেপ হবে।
সার্বভৌমত্ব বনাম প্রশাসনিক প্রভাব
তাইওয়ানের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “এই পরিস্থিতিতে দুই প্রান্তের সম্পর্ক সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন থেকে সরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় রূপ নিতে পারে।”
আরেক কর্মকর্তা জানান, “চীনের নতুন অর্থনৈতিক নীলনকশা কিনমেনের ওপর বাস্তব প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে দিতে পারে, যা তাদের ‘একীকরণ এজেন্ডা’র অংশ।”

তাইওয়ানের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
তাইওয়ানের মেইনল্যান্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল জানিয়েছে, বেইজিংয়ের পরিকল্পনার বিস্তারিত প্রকাশের আগে তারা কোনো মন্তব্য করবে না।
অন্যদিকে কিনমেনের সংসদ সদস্য ও কেএমটি রাজনীতিক জেসিকা চেন বলেন, “চীন অর্থনৈতিক একীকরণ চায়, কিন্তু সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। কিনমেন প্রজাতন্ত্র চীনের অংশ — এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”
পুরোনো পরিকল্পনা ও নতুন ঝুঁকি
চীনের পূর্ববর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোতেও তাইওয়ানের উল্লেখ ছিল, যেমন দুই হাজার ষোলো সালের ত্রয়োদশ পরিকল্পনায় দ্বীপে সুড়ঙ্গ নির্মাণ ও দ্রুতগতির রেল সংযোগের প্রস্তাব ছিল — যা তাইওয়ান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তবে এবার পরিস্থিতি আরও জটিল। শিয়ামেনে নির্মাণাধীন নতুন বিমানবন্দর কিনমেন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, যা নিরাপত্তা ও বিমান চলাচলের ঝুঁকি তৈরি করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
‘পরবর্তী ক্রিমিয়া’ আশঙ্কা
তাইওয়ানের কর্মকর্তাদের মতে, চীনের এ ধরনের অবকাঠামো প্রকল্প ভবিষ্যতে কিনমেনের ওপর প্রশাসনিক দাবি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

এক কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, “যদি তারা জোর করে কিনমেনে প্রবেশের চেষ্টা করে, তবে আমরা ‘পরবর্তী ক্রিমিয়া’ হয়ে যাব।”
দুই হাজার চৌদ্দ সালে রাশিয়া যেভাবে গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করেছিল, তাইওয়ান আশঙ্কা করছে চীন তেমনই কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে — যদিও কিনমেনের বাসিন্দারা নিজেদের ‘রিপাবলিক অব চায়না’র নাগরিক হিসেবেই পরিচিত করেন।
আকাশসীমা ও যোগাযোগের উদ্বেগ
তাইওয়ান জানিয়েছে, চীন কোনো পরামর্শ ছাড়াই গত বছর শিয়ামেন থেকে নতুন আকাশপথ চালু করেছে, যা কিনমেনের আকাশসীমার খুব কাছ দিয়ে যায়।নতুন বিমানবন্দর উদ্বোধনের পর চীন যদি এই অঞ্চলকে ‘সমন্বিত উন্নয়ন এলাকার’ অংশ হিসেবে ঘোষণা করে, তাহলে তা নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব উভয় ক্ষেত্রেই উদ্বেগজনক হবে।
তাইওয়ানের কর্মকর্তারা বলছেন, পারস্পরিক উন্নয়ন খারাপ নয়, কিন্তু যদি সেটি দখল বা সংযুক্তির উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা সরাসরি নিরাপত্তা হুমকি।
চীনের এই পরিকল্পনা তাইওয়ান-চীন সম্পর্ককে এক নতুন ধাপে নিয়ে যেতে পারে — যেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক সংযোগের আড়ালে সার্বভৌমত্বের বাস্তব চ্যালেঞ্জ লুকিয়ে রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















