রহস্যময় নিউট্রিনো: মহাবিশ্বের অদৃশ্য কণিকা
নিউট্রিনো হলো এমন ক্ষুদ্র কণিকা, যাদের কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই এবং তারা প্রায় সব কিছুর মধ্য দিয়েই চলে যেতে পারে, কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে। প্রতি সেকেন্ডে অগণিত ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো আমাদের শরীর ভেদ করে যায়, অথচ আমরা তা বুঝতেও পারি না। তবুও বিজ্ঞানীরা এখনও এই রহস্যময় কণিকাগুলোকে পুরোপুরি বুঝতে পারেননি।
নতুন গবেষণায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের দুটি বড় নিউট্রিনো গবেষণা প্রকল্পের যৌথ ফলাফলে এই কণিকাগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভুল তথ্য পাওয়া গেছে।
নিউট্রিনো সূর্যের কেন্দ্রে, বিস্ফোরিত তারায় বা মহাজাগতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়। এগুলো তিন ধরনের—যেগুলোকে বলা হয় “ফ্লেভার।” এই কণিকাগুলো এক প্রকার থেকে আরেক প্রকারে পরিবর্তিত হতে পারে, যা ‘অসিলেশন’ নামে পরিচিত। নতুন গবেষণায় এই তিন ধরনের নিউট্রিনোর ভর পার্থক্য সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া গেছে, যা দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত প্রশ্ন ছিল।
নিউট্রিনোর গুরুত্ব কেন এত বেশি
নিউট্রিনো মৌলিক কণিকা—অর্থাৎ এগুলো কোনো ছোট উপাদান দ্বারা গঠিত নয়। মহাবিশ্বের গঠনে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটন বা ইলেকট্রনের মতো অন্যান্য কণিকার বিপরীতে নিউট্রিনোর কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নিউট্রিনো বোঝা গেলে মহাবিশ্বের কয়েকটি বড় রহস্য উন্মোচিত হতে পারে—যেমন বস্তু ও অ্যান্টিম্যাটারের ভারসাম্যহীনতা, অন্ধকার পদার্থ ও অন্ধকার শক্তির প্রকৃতি, কিংবা সুপারনোভার অভ্যন্তরীণ গঠন।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের যুগল পরীক্ষা
যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত NOvA পরীক্ষাতে শিকাগোর ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাক্সেলারেটর ল্যাব থেকে প্রায় ৮১০ কিলোমিটার দূরে মিনেসোটার অ্যাশ রিভারে অবস্থিত একটি ডিটেক্টরে ভূগর্ভে নিউট্রিনো বিম পাঠানো হয়।
অন্যদিকে, জাপানের T2K পরীক্ষাতে টোকাই শহর থেকে কামিওকা শহরের মধ্যে প্রায় ২৯৫ কিলোমিটার দূরত্বে পৃথিবীর ভূত্বক পেরিয়ে নিউট্রিনো বিম পাঠানো হয়।
দুটি পরীক্ষাই নিউট্রিনোর অসিলেশন পর্যবেক্ষণ করছে, তবে তাদের শক্তি, দূরত্ব ও ডিটেক্টরের নকশা একে অপরের থেকে ভিন্ন। প্রায় এক দশকের তথ্য একত্র করে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছেন। এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে Nature জার্নালে।
গবেষকদের মন্তব্য
“প্রথমদিকে আমরা ভাবছিলাম, T2K এবং NOvA পরীক্ষার ফলাফল হয়তো মিলবে না। কিন্তু এখন দেখছি, এগুলো অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ,” বলেন মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানী কেন্ডাল মান।
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক জোয়া ভাল্লারি জানান, “আমরা এখনও জানি না কোন ধরনের নিউট্রিনো সবচেয়ে হালকা, কিন্তু এই গবেষণায় আমরা দুই ধরনের নিউট্রিনোর ভর ব্যবধানকে ২ শতাংশেরও কম অনিশ্চয়তায় মাপতে পেরেছি—যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভুল পরিমাপ।”
পদার্থ বনাম অ্যান্টিপদার্থের রহস্য
দুটি পরীক্ষাই আরও অনুসন্ধান করছে, নিউট্রিনো ও তাদের বিপরীত কণিকা (অ্যান্টিনিউট্রিনো) এক ধরনের থেকে অন্য ধরনের রূপান্তরে ভিন্নভাবে আচরণ করে কি না।
ভাল্লারির মতে, “এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ব্যাখ্যা দিতে পারবে কেন মহাবিশ্বে পদার্থই টিকে গেছে, অ্যান্টিপদার্থ নয়। বিগ ব্যাং-এর সময় এদের পরিমাণ সমান থাকার কথা ছিল, কিন্তু কোনো এক কারণে পদার্থ বিজয়ী হয়েছে, আর আমরা আজ তার ফলেই অস্তিত্বে আছি।”
ভবিষ্যতের দিগন্ত
অত্যন্ত নিখুঁত ও পরিসংখ্যানগতভাবে নির্ভরযোগ্য পরিমাপ পেতে নতুন প্রজন্মের বৃহৎ নিউট্রিনো প্রকল্প তৈরি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে DUNE প্রকল্প, জাপানে হাইপার-কামিওকান্ডে, চীনে JUNO, এবং মহাকাশীয় নিউট্রিনো ধরার জন্য KM3NeT ও আইসকিউব টেলিস্কোপ ইতিমধ্যেই কাজ করছে।
“নিউট্রিনোর রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য, এবং আমরা এখনও সেগুলো সম্পর্কে শেখার প্রক্রিয়ায় আছি,” বলেন গবেষক মান।
: #বিজ্ঞান #নিউট্রিনো #যুক্তরাষ্ট্র #জাপান #গবেষণা #মহাবিশ্ব #পদার্থবিজ্ঞান
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















