পাহাড়ি সৌন্দর্যের দেশে সুযোগের শূন্যতা
কাঠমান্ডু থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে পাহাড়ঘেরা ছোট্ট গ্রাম চামখার-এ বসে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন ২২ বছর বয়সী রাজেন্দ্র তামাং। চারপাশে সোনালি ভুট্টাক্ষেত, সবুজ ঢালু পাহাড় ও হিমালয়ের চূড়া—তবু কাজের সুযোগ প্রায় নেই। নেপালের অন্য এলাকাও একই রকম। চাকরির অভাব, সামান্য বেতনের জন্যও তীব্র প্রতিযোগিতা, আর সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে তামাংয়ের মতো তরুণদের মনোবল ভেঙে পড়ছে।
দুই বছর আগে তামাং দুবাইয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে দিনে ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করতেন—কখনও অফিস সহকারী, কখনও পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কখনও গুদামে শ্রমিক। নেপালের তুলনায় চার গুণ বেশি আয় হলেও শরীর ও মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ছুটির দিনে শপিং মলে ঘুরে তিনি দেখলেন, বারিস্টা ও সেক্রেটারির চাহিদা অনেক। তাই দেশে ফিরে দুই মাসের বারিস্টা প্রশিক্ষণ নিলেন, শিখলেন কফি মেশিন চালানো, ঠান্ডা কফির ধরন ও দুধের ফেনায় নকশা আঁকা। এখন তাঁর আশা, এই দক্ষতা তাঁকে বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ এনে দেবে। ‘আমি শুধু নেপালে কাজ করতে চাই না,’ বললেন তামাং। ‘বের হয়ে যেতেই হবে।’
সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও তরুণদের ক্ষোভ
নেপালের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের ক্যাফে—সব জায়গাতেই তরুণদের হতাশার সুর। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছেন, কেউ স্কুলও শেষ করতে পারেননি—তবু সবারই এক কথা: ‘এখানে ভবিষ্যৎ নেই।’

চিরস্থায়ী বেকারত্ব ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের অভাবে অর্থনীতি স্থবির। দেশের মোট জিডিপির এক-তৃতীয়াংশই বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সে নির্ভরশীল। কিন্তু নাগরিকেরা প্রতিদিনের জীবনে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতায় জর্জরিত।
এই অসন্তোষই সেপ্টেম্বরের শুরুতে ‘জেন জি আন্দোলন’-এ রূপ নেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও ‘নেপো কিডস’ বা সুবিধাভোগী অভিজাত সন্তানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। হাজারো ছাত্র-তরুণ রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে, শেষ পর্যন্ত পতন হয় সরকারের।
‘ঘুষ এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে,’ বলেন ৩২ বছর বয়সী ট্যাক্সিচালক লাল বাহাদুর ঘিসিং, যিনি দুই বছর মালয়েশিয়ায় কাজ করে সঞ্চয় দিয়ে এখন নিজেই ট্যাক্সি চালান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে নেপাল এশিয়ার অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সরকারি কর্মকর্তারা প্রকল্পের টাকায় হাত দেন, যার বড় অংশ থেকেই তারা জমি, বাড়ি বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন।
তবে এই বিক্ষোভ শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধেই নয়; এটি ছিল তরুণদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও আটকে থাকা সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
দেশ ছাড়ার চাপ
বিক্ষোভের পাঁচ দিন পর কাঠমান্ডুর পাসপোর্ট অফিসে আবার ভিড়। শত শত তরুণ-তরুণী হাতে নথি নিয়ে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে। অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো পাসপোর্ট করতে এসেছে।
২৯ বছর বয়সী সুনীতা বিশ্বকর্মা সকাল ৯টায় অফিস খোলার আগেই উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বেকার, তবু পাসপোর্ট করতে এসেছেন ভাইয়ের পরামর্শে, যিনি কুয়েতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। ভাই নাকি বলেছেন, ‘বিদেশে গেলে অন্তত জীবনটা ভালো।’
সুনীতা চান তাঁর তিন সন্তান নেপালেই বড় হোক, কিন্তু অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তাঁকে ভাবাচ্ছে। ‘এখানকার পরিস্থিতি আমাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে,’ বলেন তিনি।
২০২৩ সালের জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নেপালিদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেকার—যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। ২০০১ থেকে ২০২১-এর মধ্যে বিদেশে কর্মরত নেপালিদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে ২২ লাখে পৌঁছেছে, যার তিন-চতুর্থাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৪।
শ্রমনির্ভর অর্থনীতি
প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার নেপাল থেকে প্রতি বছর গালফ, পর্তুগাল, গ্রিস-সহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অদক্ষ শ্রমিক যায়। কেউ গুদামে মালামাল তোলে, কেউ রেস্টুরেন্টে সবজি কাটে, কেউ নির্মাণস্থলে ট্রাক চালায়।

সরকারি তথ্য বলছে, চারটির মধ্যে একটি পরিবারে অন্তত একজন সদস্য বিদেশে থাকে। এর বিনিময়ে পরিবারগুলো হারায় আপনজনকে বছরের পর বছর, কিন্তু টিকে থাকে রেমিট্যান্সের টাকায়—যা দিয়ে চলে শিক্ষা, চিকিৎসা ও ঘরবাড়ি পুনর্গঠন।
‘পরিবারে কেউ না কেউ বিদেশে না গেলে টিকে থাকা কঠিন,’ বলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান-পড়ুয়া তেনজিন ডোলকার। তাঁর মা ১৫ বছর ইসরায়েলে গৃহকর্মীর কাজ করেছেন—মাত্র তিনবার দেশে ফিরেছেন। ‘তবু ওই টাকায়ই ঘর তৈরি হয়েছে,’ বলেন তেনজিন।
‘নেপো কিডস’ বিতর্ক ও নতুন বিভাজন
হার্ভার্ড শিক্ষিত সাবেক মিস নেপাল শ্রীঙ্কলা খাতিওয়াডা ছিলেন তরুণদের প্রেরণা। ১০ লাখের বেশি অনুসারীসহ তিনি সামাজিক মাধ্যমে রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে সরব ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের আগমুহূর্তে তিনি নিজেই ক্ষোভের কেন্দ্রে পড়েন—বিলাসবহুল পণ্যের প্রচার ও বিদেশ সফরের জন্য তাঁকে ‘নেপো কিড’ বলা হয়।
শ্রীঙ্কলার বাবা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আর তাঁর শ্বশুর নেপালের বৃহত্তম গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক। আন্দোলনে তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
‘আমি আন্দোলনের লক্ষ্যকে সমর্থন করতে চেয়েছিলাম,’ বলেন শ্রীঙ্কলা এক সাক্ষাৎকারে। ‘কিন্তু আমাকেই শত্রু বানানো হলো।’ তিনি জানান, তাঁর নীরবতা এসেছে ‘আঘাত ও মানসিক চাপ’ থেকে, সুবিধাভোগী অবস্থান থেকে নয়।
তরুণদের একাংশ মনে করে, এই আন্দোলন কেবল শহুরে মধ্যবিত্তের ক্ষোভ প্রকাশ, যা তাদের বাস্তব জীবনে কোনো পরিবর্তন আনেনি। বরং অস্থিরতা বাড়িয়েছে। ‘কিশোরদের জন্য কিছুই বদলায়নি,’ বলেন তেনজিন ডোলকার। ‘এখন তারা আরও দ্রুত দেশ ছাড়তে চায়।’
নেপালের পাহাড়, মন্দির ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক প্রজন্মের হতাশা। সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক তরুণের কাছে বিদেশই একমাত্র আশার পথ। আর যারা রয়ে গেছে, তাদের চোখে প্রতিদিনই ঝরে এক নিঃশব্দ প্রশ্ন—‘এই দেশ কি কখনও বদলাবে?’
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















