মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম জানিয়েছেন, আসিয়ান (ASEAN) ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তি পর্যালোচনায় ‘বাস্তব অগ্রগতি’ অর্জিত হয়েছে। রোববার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত আসিয়ান-ভারত শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই বছরের মধ্যেই চুক্তি পর্যালোচনা শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কুয়ালালামপুরে আসিয়ান-ভারত শীর্ষ সম্মেলন
সম্মেলনে আনোয়ার বলেন, “আমরা চাই আসিয়ান-ইন্ডিয়া ট্রেড ইন গুডস অ্যাগ্রিমেন্ট (AITIGA) এই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হোক।”
তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে “আসিয়ানের বন্ধু এবং ব্যক্তিগতভাবেও আমার বন্ধু” বলে উল্লেখ করেন।
চুক্তির পটভূমি ও অগ্রগতি
আসিয়ান-ভারত বাণিজ্য চুক্তিটি ২০০৯ সালের আগস্টে স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। এর পর্যালোচনার ক্ষেত্র ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত হয়, আর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয় ২০২৩ সালের মে মাসে।
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’-র মূল ভিত্তি হিসেবেই আসিয়ানকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “ভারত সর্বদা আসিয়ানের কেন্দ্রীয় ভূমিকা ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই বছরের আসিয়ান সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু ‘অন্তর্ভুক্তি ও স্থায়িত্ব’। তা প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়—ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই সাপ্লাই চেইন গঠনের মধ্য দিয়ে।”

ভারতীয় পক্ষের বক্তব্য ও সময়সীমা
ভারতের বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগরওয়াল জানান, চুক্তি পর্যালোচনায় ইতিমধ্যে একাধিক দফা আলোচনা হয়েছে। “গত দুই মাসে বাজারে প্রবেশাধিকারসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে,” তিনি বলেন।
আগরওয়াল আশা প্রকাশ করেন, এই অগ্রগতি শিগগিরই একটি ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছাবে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বছরের শেষ নাগাদ পর্যালোচনা সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে।
বর্তমানে আসিয়ান ভারতের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১১ শতাংশের জন্য দায়ী, কিন্তু বাণিজ্যের ভারসাম্যটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষেই বেশি। এই ভারসাম্য পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে নয়াদিল্লি।
মোদির অনুপস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
কুয়ালালামপুর সম্মেলনে মোদির অনুপস্থিতি ঘিরে নানা জল্পনা ছিল। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, তিনি মালয়েশিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। তবে পরে নিশ্চিত করা হয় যে, মোদি ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন।
জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহযোগী অধ্যাপক শ্রাবণা বরুয়া বলেন, “মোদির অনুপস্থিতি বিস্ময়কর। গত বছর ভিয়েনতিয়ানে তিনি আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারে ১০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন, যার একটি ছিল এই বছরের মধ্যে চুক্তি পর্যালোচনা সম্পন্ন করা।”
বরুয়া মনে করেন, ট্রাম্পের উপস্থিতি মোদির অংশগ্রহণ না করার অন্যতম কারণ হতে পারে। “ট্রাম্প প্রকাশ্যে এমন কিছু দাবি করেন যা সত্য নাও হতে পারে—সম্ভবত সেটিই মোদির দূরত্ব বজায় রাখার কারণ,” তিনি বলেন।
তিনি আরও যোগ করেন, “মোদির উপস্থিতি থাকলে আলোচনায় গতি আসত। এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্দার আড়ালের আলোচনা হাতছাড়া হলো।”

আসিয়ান নেতাদের অবস্থান
সম্মেলনে আসিয়ান নেতারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র বলেন, “বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলা ভারতের সঙ্গে আসিয়ানের সম্পর্ক দৃঢ় করা সময়ের দাবি।”
তিনি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব বিস্তার প্রসঙ্গে বলেন, “আসিয়ান ও ভারতের উচিত আইনভিত্তিক নৌ-আচরণ ও শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা—কারণ সমুদ্র আমাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির উৎস।”
বিশেষজ্ঞ মত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক বিষয়ক চিন্তাধারা কেন্দ্র ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল ইন্ডিয়া ইনসাইটস’-এর প্রধান মানীশ চাঁদ মনে করেন, চুক্তি পর্যালোচনায় এখনো উভয় পক্ষ একমত নয়। তিনি বলেন, “পণ্যের উৎস নির্ধারণে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। ভারত আশঙ্কা করছে, চীনের তৈরি কিছু পণ্য আসিয়ান হয়ে ভারতের বাজারে প্রবেশ করছে।”
অন্যদিকে, বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সহযোগী ফেলো প্রেরণা গান্ধী বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য শুল্ক অনিশ্চয়তার মধ্যে আসিয়ান চুক্তির পর্যালোচনা শেষ করা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভারতের আসিয়ান ও পূর্ব এশিয়ার মূল্যচেইনের (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি) সঙ্গে সংযোগ জোরদার হবে।”
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের ঘোষণা আসিয়ান-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যদিও সময়সীমা ও রাজনৈতিক জটিলতা চুক্তি সম্পন্নে প্রতিবন্ধক হতে পারে, তবুও সাম্প্রতিক আলোচনায় উভয় পক্ষের সদিচ্ছা ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতা ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক ভারসাম্যের পথে একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
#আসিয়ান #ভারত #বাণিজ্যচুক্তি #আনোয়ার_ইব্রাহিম #নরেন্দ্র_মোদি #AITIGA #কুয়ালালামপুর #ইন্দো_প্যাসিফিক #আন্তর্জাতিক_সম্পর্ক
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















