ইতিহাসের পুনঃপাঠ: ‘মূল পাপ’ ও জাতির আত্মচিত্র
আমেরিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সবসময়ই বিতর্ক ও গৌরবের এক জটিল সংমিশ্রণ। ইতিহাসবিদ জোসেফ জে. এলিস তাঁর নতুন গ্রন্থ দ্য গ্রেট কনট্রাডিকশন: দ্য ট্র্যাজিক সাইড অব দ্য আমেরিকান ফাউন্ডিং-এ সেই ইতিহাসকে সৎভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে দাসপ্রথা ও আদিবাসী নিপীড়ন—দেশটির জন্মলগ্নের দুই গভীর ক্ষত—আমেরিকার গৌরবগাথার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে।
এলিস বলেন, এই বইটি তিনি লিখেছেন এমন এক সময়, যখন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে গভীরভাবে বিভক্ত এবং ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের আড়ালে বর্ণবাদ আবার মাথা তুলছে। তবে তাঁর কাজ ‘১৬১৯ প্রজেক্ট’-এর মতো দেশকে দোষারোপ করে না; বরং দেখায়, কীভাবে এই দ্বন্দ্বের মাঝেও জাতির উত্থান ঘটেছে।
প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্মকে মিথ থেকে মুক্ত করার প্রয়াস
এলিসের মতে, আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা নেতারা প্রায়ই অতিরঞ্জিত বীর হিসেবে উপস্থাপিত হন। অথচ তিনি চেয়েছেন তাঁদের সেই ‘তড়িৎচৌম্বক মিথের ক্ষেত্র’ থেকে উদ্ধার করতে। গত চার দশক ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তিন প্রেসিডেন্টের জীবনী ও Founding Brothers (২০০০)-এর মতো জনপ্রিয় বইয়ের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন।

বিপ্লবকালীন ঘটনাগুলিতে তিনি তুলে ধরেছেন দাসপ্রথার নৈতিক ও কৌশলগত জটিলতা। ব্রিটেন যখন দাসদের স্বাধীনতা দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানায়, জর্জ ওয়াশিংটনের এক সহকারী প্রস্তাব করেন—চার্লসটন রক্ষায় ৩,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মুক্তি দিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হোক। আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু দক্ষিণ ক্যারোলিনার আইনসভা তা বাতিল করে। পরিণতিতে ১৭৮০ সালে ব্রিটিশ বাহিনী চার্লসটন ধ্বংস করে দেয়—যা এলিসের ভাষায়, “যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ পরাজয়।”
নৈতিকতা বনাম বাস্তবতা: সংবিধানের দ্বন্দ্ব
এলিস লিখেছেন, ‘আমেরিকার প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতারা ইউটোপিয়ান স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন না; তাঁরা ছিলেন বাস্তববাদী রাষ্ট্রনায়ক।’
১৭৮৭ সালের সংবিধান রচনার সময় দাসপ্রথার বিষয়ে আপস করা যে নৈতিকভাবে ভুল ছিল, তা তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে উল্লেখ করেছেন—যদি সেই আপস না করা হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতো না। এমনকি হয়তো দেশটি তখনই একাধিক সার্বভৌম অঙ্গরাজ্যের আলগা সংঘে পরিণত হতো, যেমনটি ১৮৬১ সালে কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকার ক্ষেত্রে দেখা যায়।
টমাস জেফারসনের দ্বিচারিতা
![]()
এলিস ইতিহাসের নায়কদেরও ছাড় দেননি। তিনি তুলে ধরেছেন টমাস জেফারসনের এক নির্মম বৈপরীত্য। স্বাধীনতার ঘোষণার ৫০তম বার্ষিকীতে জেফারসন লিখেছিলেন—‘মানবজাতির বেশিরভাগই পিঠে জিন পরে জন্মায়নি, আর কিছু বিশেষ মানুষ ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় তাদের চালানোর অধিকার পায়নি।’ অথচ কিছু মাস পরেই তাঁর এস্টেট ১৩০ জন দাস বিক্রি করে দেয়, পরিবারগুলোকে আলাদা করে ফেলে, এবং কিছুজনকে পাঠায় মিসিসিপি ও লুইজিয়ানার নির্মম তুলাক্ষেত্রে।
আদিবাসী উচ্ছেদ: গণতন্ত্রের এক করুণ পরিণতি
বইটিতে দাসপ্রথার শিকারদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া হলেও, এলিস স্বীকার করেছেন যে ‘আদিবাসীদের সঙ্গে ন্যায্য সমঝোতায় ব্যর্থতা ছিল বিপ্লবী প্রজন্মের আরেকটি বড় ব্যর্থতা।’
তিনি জর্জিয়ার ক্রিক ইন্ডিয়ানদের উচ্ছেদকে একটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভাষায়, “ইন্ডিয়ান রিমুভাল ছিল লাগামহীন গণতন্ত্রের অবধারিত পরিণতি।”

তৎকালীন ফেডারেল সরকার এই উচ্ছেদ ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল। ওয়াশিংটন, জেফারসন ও হেনরি নক্স জানতেন—এটি তাদের ঘোষিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। তাঁরা ক্রিক নেতাদের সঙ্গে ন্যায্য চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন, কিন্তু নবীন প্রজাতন্ত্রের হাতে যথেষ্ট সামরিক শক্তি ছিল না। ফলে জর্জিয়ার অভিবাসীরা পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে, এবং চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। এলিস লিখেছেন, “তাঁরা এক সাহসী চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন—এবং তাঁদের আর কিছু করারও ছিল না।”
আমেরিকার ইতিহাস: ব্যর্থতা, আপস ও জটিলতার শিক্ষা
এলিস মনে করেন, আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো—যেখানে সৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, অথচ ভণ্ডামিপূর্ণ আপসই কখনো কখনো কম ক্ষতিকর সমাধান হয়ে দাঁড়ায়।
এই জটিলতাই ইতিহাসকে এত আকর্ষণীয় করে তোলে, এবং এটিই প্রমাণ করে—ইতিহাসকে কখনো সহজ রাজনৈতিক বিভাজনে ভাগ করা যায় না।
তবে লেখক নিকোলাস ক্লেয়ারমন্টের মতে, অন্তত লেখার গুণে আমরা পক্ষ নিতে পারি—আর সেই দিক থেকে জোসেফ জে. এলিসের দলে থাকা শ্রেয়।
#আমেরিকারইতিহাস #দাসপ্রথা #আদিবাসীউচ্ছেদ #জোসেফএলিস #দ্যগ্রেটকনট্রাডিকশন #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















