জ্যামাইকায় সর্বকালের শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের হুমকি
ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপ রাষ্ট্র জ্যামাইকা বর্তমানে ইতিহাসের ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে। সোমবার দুপুর নাগাদ ‘মেলিসা’ ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭৫ মাইল (প্রায় ২৮২ কিলোমিটার) ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার (এনএইচসি) জানিয়েছে, এটি সাফির-সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৫—অর্থাৎ ‘বিপর্যয়কর’ মাত্রার ঝড়।
এই ঝড় সোমবার গভীর রাতে বা মঙ্গলবারের প্রথম প্রহরে জ্যামাইকায় সরাসরি আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর মঙ্গলবার রাতের দিকে এটি পূর্ব কিউবায় পৌঁছাবে এবং বুধবার নাগাদ বাহামা ও টার্কস অ্যান্ড কাইকোস দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করবে।
ধীরগতির ঝড়ে বাড়ছে ধ্বংসের আশঙ্কা
ক্যারিবীয় সাগরের অস্বাভাবিক উষ্ণ পানির ওপর ধীরগতিতে চলার কারণে মেলিসার আকার ও শক্তি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পরিস্থিতি জ্যামাইকায় নজিরবিহীন বৃষ্টি (প্রায় ৩ ফুট পর্যন্ত) ও বিপর্যয়কর ঝোড়ো হাওয়া বয়ে আনতে পারে।
বর্তমানে মেলিসার বাতাসের বিস্তৃতি পুরো জ্যামাইকা দ্বীপের দৈর্ঘ্যের চেয়েও বড়, যেখানে দ্বীপটির প্রধান বিমানবন্দরগুলো অবস্থিত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব নিচু স্থানে।

বাধ্যতামূলক সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ
দক্ষিণ জ্যামাইকার ঐতিহাসিক বন্দরনগরী পোর্ট রয়্যালসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বাধ্যতামূলক সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হোলনেস। তিনি বিদেশি সহায়তা চেয়েছেন এবং সতর্ক করেছেন—এই ঝড় কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, সেতু, সড়ক, বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
সরকারি হিসাবে প্রায় ২৮ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তারা লুটপাটের আশঙ্কায় বাড়িঘর ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ বাস প্রস্তুত রেখেছে, কিন্তু অনেকেই এখনো যাত্রা করেননি।
“এই অঞ্চলের কোনো অবকাঠামোই ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার ঝড় সহ্য করতে পারবে না,” বলেন প্রধানমন্ত্রী হোলনেস।
প্রস্তুতি ও আশঙ্কা
সরকার জরুরি সহায়তার জন্য ৩৩ মিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছে এবং আগের বছরের হারিকেন বেরিলের ক্ষতির তুলনায় কিছুটা বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ধরে বিমা ও ঋণ কাঠামো তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের হারিকেন বেরিল ছিল ইতিহাসের প্রথম ও দ্রুততম ক্যাটাগরি ৫ আটলান্টিক ঝড়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণ সাগরের পানি ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতি ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা
অ্যাকিউওয়েদার প্রধান আবহাওয়াবিদ জোনাথন পোর্টার জানান, “দশ হাজারের বেশি পরিবার ঘণ্টায় ১০০ মাইলের বেশি গতির বাতাস ও টানা বৃষ্টির কবলে পড়বে। এতে অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেলে সহায়তা পৌঁছানো দুষ্কর হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ধীরগতির বড় ঝড়গুলো ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক হিসেবে পরিচিত। এটি এক ভয়ংকর পরিস্থিতি, যা ধীরে ধীরে বিপর্যয়ে রূপ নিচ্ছে।”
জ্যামাইকার ইতিহাসে নজিরবিহীন হুমকি
জ্যামাইকার আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তা ইভান থম্পসন জানান, ১৯৮৮ সালের ক্যাটাগরি ৪ হারিকেন গিলবার্ট ছিল দ্বীপটির বড় আঘাতগুলোর একটি, কিন্তু ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার কোনো ঝড় জ্যামাইকায় কখনো সরাসরি আঘাত হানেনি।
তিনি বলেন, “মেলিসা গিলবার্টের চেয়েও ধীরগতির, অর্থাৎ এই ঝড় কয়েকদিন ধরে স্থায়ী হতে পারে। অনেক অঞ্চল সপ্তাহব্যাপী যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।”

ভয় ও বিচ্ছিন্নতা
ব্লু মাউন্টেনের হেগলি গ্যাপ শহরের শিক্ষক ডেমিয়ান অ্যান্ডারসন জানান, “আমরা নড়তে পারছি না। সড়কগুলো অচল হয়ে গেছে। আমরা ভীত—এমন বহুদিনব্যাপী বিপর্যয় আগে কখনো দেখিনি।”
প্রতিবেশী দ্বীপগুলোও বিপর্যস্ত
নিকটবর্তী হাইতি ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। হাইতিতে দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকাগুলো থেকে ৩,৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ অস্থায়ী আশ্রয়ে চলে গেছেন। কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট ও নৌযাত্রা স্থগিত করেছে।
বাহামার প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ ডেভিস দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে কিউবার পূর্বাঞ্চলও ঝড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিউবা সরকার জানিয়েছে, উপকূলীয় ও পার্বত্য এলাকায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পূর্ব কিউবায় স্কুল ও গণপরিবহন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু সান্তিয়াগো দে কিউবা শহরেই ২.৫ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে—যা ঝড়ের সরাসরি পথে অবস্থিত।
জ্যামাইকা ও আশপাশের দেশগুলো এখন এক নজিরবিহীন সংকটের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ধরনের ঝড় আরও ঘন ও শক্তিশালী হচ্ছে—যা গোটা ক্যারিবীয় অঞ্চলের জন্য এক নতুন ও ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি করছে।
#ঘূর্ণিঝড়_#মেলিসা,# জ্যামাইকা, #কিউবা, #বাহামা, #হাইতি, #প্রাকৃতিক_#দুর্যোগ, #জলবায়ু_পরিবর্তন, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















