প্রাচীন কায়ুগা শিল্পের উত্তরাধিকার
কেন মারাকল, কানাডার কায়ুগা নেশনের সদস্য, এমন এক শিল্পরূপের ধারক যা উত্তর আমেরিকার আদিবাসী ইতিহাসের গভীর প্রতীক—ওয়াম্পাম বেল্ট তৈরির ঐতিহ্য। শতাব্দী-প্রাচীন এই শিল্পে বেগুনি ও সাদা রঙের কাঁচ বা শামুকের খোলের পুঁতি দিয়ে জ্যামিতিক নকশা বোনা হয়। একসময় ভুলভাবে ধারণা করা হতো যে ওয়াম্পাম ছিল আদিবাসীদের মুদ্রা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল কূটনৈতিক প্রতিশ্রুতি, বন্ধুত্ব ও চুক্তির প্রতীক, যা আদিবাসী জাতি ও ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হতো।
মারাকল প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন, তৈরি করেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি ঐতিহাসিক বেল্টের প্রতিরূপ। তার তৈরি শিল্পকর্ম যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব দ্য আমেরিকান ইন্ডিয়ান এবং কানাডার মিউজিয়াম অব হিস্টরিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
বেগুনি রঙে রঞ্জিত জীবন ও কর্মশালা
৭৪ বছর বয়সেও মারাকলের প্রাণশক্তি অবিশ্বাস্য। তার জিপ গাড়ির নাম্বার প্লেটে লেখা ‘WAMPUM’, এবং তার পোশাক থেকে শুরু করে কর্মশালার দেয়াল পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রধান রঙ বেগুনি—ওয়াম্পামের ঐতিহ্যবাহী শামুকের খোল থেকে পাওয়া সেই প্রাকৃতিক রঙ।
তিনি দক্ষিণ অন্টারিওর ওহসউইকেনে বসবাস করেন, যা সিক্স নেশনস কনফেডারেসির কেন্দ্রস্থল। বাড়ির পাশেই ছোট একটি স্টুডিও, যেখানে তার সঙ্গী মেলিন্ডা ট্রুডোর সহায়তায় তিনি কাজ করেন। দেয়ালে ঝুলছে নানা নকশার বেল্ট—কখনও গাঢ় বেগুনি রেখায় সাদা প্রতীক, কখনও বা উল্টো রঙে তৈরি জ্যামিতিক চিত্র।
ঐতিহ্যের কারিগরি রূপ
ওয়াম্পাম তৈরির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও মানসিকভাবে ক্লান্তিকর। একটি জটিল বেল্টে ১৩,০০০ পর্যন্ত পুঁতি থাকতে পারে এবং এটি সম্পূর্ণ করতে ৯০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। মারাকল একটি হাতের তৈরি তাঁতে কাজ করেন, যেখানে হরিণের স্নায়ুসদৃশ সিন্থেটিক সূতো টান টান করে বাঁধা।
তার বর্তমান কাজের নাম “ফ্রেন্ডশিপ বেল্ট”—এক প্রান্তে একটি মানবাকৃতি, যা বেগুনি রেখা ধরে অপর প্রান্তের আরেক মানবাকৃতির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি পুঁতি বসানোর সময় তিনি মনোযোগ সহকারে গুনে রাখেন, বলেন, “ওভার, আন্ডার, ওভার, আন্ডার।”
ইতিহাসের প্রতীকী গল্প
মারাকলের প্রতিটি বেল্টের পেছনে আছে কোনো না কোনো কাহিনি। একটি বেল্টে রয়েছে ‘পিসমেকার’-এর চিত্র, যিনি হাউডেনোসনি কনফেডারেসির “গ্রেট ল অব পিস”-এর প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচিত।
তিনি জানেন প্রায় ৪০০ ঐতিহাসিক বেল্টের কথা, যাদের মধ্যে ৫৪টি তিনি পুনর্নির্মাণ করেছেন। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ১৭৬৪ সালের ‘কোভেন্যান্ট চেইন ওয়াম্পাম বেল্ট’, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিচুক্তির সময়ে ব্যবহার করেছিল।
২০১৬ সালে কানাডার মিউজিয়াম অব হিস্টরি তার কাছ থেকে এই বেল্টের প্রতিরূপ সংগ্রহ করে। ওয়াম্পাম বিশেষজ্ঞ জনাথন লেইনি বলেন, “এই বেল্টগুলো ছিল কূটনীতির দৃশ্যমান প্রতীক—যাতে শব্দ ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বস্তুগত রূপ মিলত।”
সংস্কৃতি, স্মৃতি ও আত্মচেতনা
মারাকল ছোটবেলায় তার মাতৃভাষা বা সংস্কৃতি শেখেননি, কারণ তার মা স্কুলে ভাষা ব্যবহারের জন্য নির্যাতিত হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন কারখানায় মেশিনিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালে এক প্রবীণ তাকে বলেন, “তুমি জানো না এই বেল্ট কী বোঝায়, অথচ তোমার জানা উচিত।” সেই মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করেন নিজের দায়িত্ব—ঐতিহ্য রক্ষা করা।

কায়ুগা প্রধান জেকব থমাস তাকে লুম তৈরি ও বুননের কৌশল শিখিয়েছিলেন। মারাকল বলেন, “যদি তিনি প্রকৌশলী হতেন, তবে অসাধারণ হতেন।”
‘ওয়াম্পাম ম্যাজিক’ ও নতুন প্রজন্ম
মারাকলের ব্যবহৃত শামুকের খোল আসে লং আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক থেকে। এগুলো কেটে, ঘষে ও পালিশ করে তিনি তৈরি করেন সূক্ষ্ম পুঁতি। তবে অনেক সময় তিনি এই কাজের জন্য বন্ধু হ্যারি ওয়ালেসের প্রতিষ্ঠিত “ওয়াম্পাম ম্যাজিক” কোম্পানি থেকে পুঁতি সংগ্রহ করেন।
তার তৈরি সাধারণ কাঁচের পুঁতির বেল্টের দাম ১৫০ থেকে ১,৮০০ কানাডীয় ডলার পর্যন্ত, আর খাঁটি শামুকের বেল্টের দাম শুরু হয় ৩০,০০০ কানাডীয় ডলার থেকে।
শিল্পের মধ্যে আত্মোপলব্ধি
মারাকলের কাছে ওয়াম্পাম তৈরি শুধুমাত্র ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ নয়—এ এক মানসিক নিরাময়ের মাধ্যম। কাজের সময় তিনি প্রাচীন গল্পের অডিও রেকর্ডিং শোনেন এবং বেল্টের পাশে তামাক রাখেন ‘শুভ চিন্তার’ প্রতীক হিসেবে।
তিনি বলেন, “আমরা হয়তো বড় ক্ষতির উত্তর পাই না, কিন্তু শিল্পের ছোট ছোট সমস্যার সমাধান খুঁজে পাই—এটাই হয়তো এক ধরনের থেরাপি।”
চার দশকের সাধনায় কেন মারাকল শুধুমাত্র শিল্প নয়, বরং এক উত্তরাধিকারকে জীবিত রেখেছেন—যেখানে প্রতিটি বেগুনি পুঁতি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কূটনীতির সাক্ষ্য বহন করে। তার হাতের বোনা প্রতিটি বেল্ট যেন আদিবাসী চেতনার এক জীবন্ত দলিল—যেখানে অতীতের কণ্ঠস্বর আজও প্রতিধ্বনিত হয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















