বিলুপ্তির পথে ব্রিটেনের প্রাচীন কারুশিল্প
ব্রিটেনের প্রাচীন হস্তশিল্প—ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের পাথরের দেয়াল নির্মাণ থেকে শুরু করে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বুশমিলসে ব্যারেল বানানোর কুপারিং—সবই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসবিদ জেমস ফক্স তাঁর নতুন বই ক্রাফ্টল্যান্ড: ইন সার্চ অব লস্ট আর্টস অ্যান্ড ডিসঅ্যাপিয়ারিং ট্রেডস-এ এই সংকটের দলিল তুলে ধরেছেন। সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেনে প্রকাশিত বইটি ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হবে।
ফক্স বইটিতে ভ্রমণকাহিনি ও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন একত্রে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ভাষায়, “শিল্প বা কারুশিল্পকে যদি শুধুই ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয়, তবে তা অতীতে আটকে যায়। অথচ কারুশিল্প জীবন্ত ঐতিহ্য—যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।”
প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাওয়া হাতের ছোঁয়া
এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে, স্কটল্যান্ডের হুগো বার্জ ফাউন্ডেশনে এক সাক্ষাৎকারে ফক্স বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) যুগে মানুষ যেভাবে কাজ করছে, চিন্তা করছে, এমনকি জিনিস তৈরি করছে—সবকিছু বদলে যাচ্ছে। তাই এই সময়ে অতীতের কর্মপদ্ধতি ও হাতে তৈরি জিনিসগুলোর দিকে ফিরে দেখা জরুরি, “যাতে সেগুলো বিলুপ্ত হওয়ার আগে আমরা নথিবদ্ধ করতে পারি এবং সেখান থেকে শেখার সুযোগ পাই।”

বিপন্ন কারুশিল্পের তালিকা
ব্রিটেনে হেরিটেজ ক্রাফ্টস নামের একটি সংস্থা প্রতি দুই বছর অন্তর দেশের হস্তশিল্পের অবস্থা নিয়ে জরিপ করে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ কারুশিল্প এখন বিপন্ন, এবং প্রায় ৭২টি কারুশিল্প রয়েছে ‘অতি সংকটাপন্ন’ অবস্থায়—যেখানে পুরো ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন মাত্র একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠান। গত দশকে ব্রিটেনে অন্তত পাঁচটি প্রাচীন হস্তশিল্প বিলুপ্ত হয়েছে—এর মধ্যে রয়েছে স্বর্ণপাত তৈরি, ক্রিকেট বল বানানো ও ল্যাক্রোস স্টিক নির্মাণ।
ফেলিসিটি আয়রন্স: বিলুপ্ত শিল্পকে ফিরিয়ে আনা এক নারী
এই বিপন্ন ঐতিহ্যের ভেতর সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক কাহিনিগুলোর একটি ফেলিসিটি আয়রন্সের। অস্ট্রেলিয়ায় এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার পর তিনি এমন একটি পেশা খুঁজছিলেন, যেখানে দাঁড়িয়ে কাজ করা যায়। সেই সূত্রে তিনি শুরু করেন ‘রাশ উইভিং’ বা নদীর তীরে জন্মানো ঘাসজাত গাছের আঁশ দিয়ে বুনন।
বিশ শতকের পূর্বে এই রাশ উইভিং ছিল যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বহুল প্রচলিত শিল্প—গালিচা, ঝুড়ি, পোশাক, এমনকি আসবাবও বানানো হতো এ গাছ দিয়ে। কিন্তু প্লাস্টিকের যুগে এই কারুশিল্প হারিয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে ফেলিসিটি এক পুরনো নির্দেশিকা পড়ে নিজে নিজেই এই কাজ শেখেন এবং একে নতুন প্রাণ দেন। আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম দক্ষ হস্তশিল্পী।
ফেলিসিটি এই প্রাচীন শিল্পকে আধুনিক যুগের প্রয়োজনে রূপান্তরিত করেছেন—তাঁর হাতে তৈরি হয় যোগব্যায়ামের ম্যাট, সানগ্লাসের কেস, এমনকি গেম অব থ্রোনস সিরিজের জন্য কাজ করেছেন তিনি। তাঁর সাফল্য প্রমাণ করে যে কারুশিল্প সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে।

“কম কিনুন, কিন্তু ভালো কিনুন”
ফক্সের মতে, এই বই লেখার অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে—মানুষ কম কিনে ভালো মানের জিনিস কিনলে তা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও সাশ্রয়ী হয়। “হাতে তৈরি পণ্য দামি, কারণ আপনি একজন মানুষের সময়ের মূল্য দিচ্ছেন,” তিনি বলেন।
বইয়ের এক অধ্যায়ে তিনি তুলনা টেনেছেন কাঁচির উদাহরণে—“সস্তা কাঁচি কয়েকবারেই ভেঙে যাবে, কিন্তু শেফিল্ডে হাতে তৈরি একটি কাঁচি আজীবন টিকে থাকবে। আমি জানি, এই কাঁচিটি একদিন আমার সন্তানদের হাতে তুলে দেবো—এটাই প্রকৃত অর্থে মূল্যের মূল্য।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বনাম মানুষের সৃষ্টিশক্তি
ফক্স বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই কারুশিল্পের জায়গা নিতে পারবে না। তাঁর ভাষায়, “এআই কি পাহাড়ে উঠে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে একটি শতবর্ষ টেকসই দেয়াল বানাতে পারবে? বা বছরের পর বছর ধরে কাপড় জোগাড় করে ভালোবাসার মানুষকে উপহার দেওয়ার জন্য একটি কুইল্ট বানাতে পারবে?”
তিনি বলেন, “মানবিক স্পর্শ ও সময়ের বিনিয়োগই হস্তনির্মিত পণ্যের মূল্য। কুইল্ট তৈরি এক ভালোবাসার শিল্প—যেখানে এক মানুষ অন্যের জন্য সময় ও মনোযোগ দেয়।”

ফক্স মনে করেন, আমরা যতই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করছি, ততই মানুষের মধ্যে বাস্তব, স্পর্শযোগ্য জিনিসের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়বে।
জেমস ফক্সের ক্রাফ্টল্যান্ড শুধু হারিয়ে যাওয়া শিল্পের বৃত্তান্ত নয়, বরং এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রযুক্তির যুগেও মানুষের হাতে গড়া সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে এক অবিনাশী মানবিক স্পন্দন—যা কোনো যন্ত্র কখনোই অনুকরণ করতে পারবে না।
#ব্রিটিশ_কারুশিল্প,# জেমস_ফক্স, #ক্রাফ্টল্যান্ড,# হেরিটেজ_ক্রা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















