সিলিকন ভ্যালির প্রভাবশালী উদ্যোক্তা পিটার থিয়েল সম্প্রতি একাধিক বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আধুনিক সমাজ এখন “অ্যান্টিক্রাইস্ট”-এর প্রভাবের অধীনে চলছে। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)–বিরোধী মনোভাব, অতিরিক্ত নিরাপত্তাবাদ ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের আধিপত্যই মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
বাইবেলের শেষ অধ্যায় ‘বুক অব রেভেলেশন’ পৃথিবীর শেষ সময়ের নানা ভয়াবহ ঘটনার কথা বলে—ভূমিকম্প, আগুন, রক্তে মেশা বৃষ্টি এবং অশুভ শক্তির উত্থান। কিন্তু থিয়েল মনে করেন, আধুনিক কালে সেই অশুভ শক্তি রূপ নিয়েছে পরিবেশবাদী গ্রেটা থানবার্গের মতো কর্মীদের ও “ব্রাসেলসের আমলাতন্ত্রে”। তাঁর রসাত্মক মন্তব্য—“যে কেউ বেলজিয়ামে পাসপোর্ট লাইনে দাঁড়িয়েছে, সে জানে শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
‘শান্তি ও নিরাপত্তাবাদ’—অ্যান্টিক্রাইস্
থিয়েল যুক্তি দেন, গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ব এক ধরনের “শান্তি ও নিরাপত্তাবাদের” (peace and safetyism) দাসে পরিণত হয়েছে। তাঁর দাবি, বাইবেলে বলা হয়েছে “অ্যান্টিক্রাইস্টের মূল স্লোগানই হলো শান্তি ও নিরাপত্তা।” তাই, এই সংস্কৃতি যত বিস্তৃত হচ্ছে, ততই মানবসভ্যতা সাত-মাথাওয়ালা অশুভ শক্তির শাসনের দিকে যাচ্ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিতর্ক
থিয়েল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী, কিন্তু তিনি মনে করেন অতিরিক্ত নীতিনিয়ন্ত্রণ এই প্রযুক্তিকে স্তব্ধ করছে। তিনি দার্শনিক নিক বোস্ট্রমকে, যিনি AI–এর ঝুঁকি নিয়ে লেখেন, ‘অ্যান্টিক্রাইস্টের সেনানায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন।
তবে অনেকেই থিয়েলের ধারণার সঙ্গে একমত নন। ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল মার্টিন রিস বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক স্থবিরতা”র এই ধারণা পুরোপুরি “অর্থহীন”। বোস্ট্রম নিজে শুধু বলেন, “আমি তাঁর হতাশা বুঝি,”—যদিও সেটি শয়তানের পক্ষ থেকে নয়।
ইতিহাসে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’-এর পুনরাবৃত্তি
ইতিহাসে অসংখ্যবার অ্যান্টিক্রাইস্টের ধারণা ব্যবহার হয়েছে। প্রাচীন রোমের সম্রাট নিরো থেকে শুরু করে বিল গেটস পর্যন্ত অনেককেই এই প্রতীকে তুলনা করা হয়েছে। মধ্যযুগে ক্রুসেডাররা মুসলিম সেনাদের অ্যান্টিক্রাইস্টের সৈন্য মনে করত; রিফর্মেশনের সময় প্রোটেস্ট্যান্টরা পোপকে অ্যান্টিক্রাইস্ট বলত। এমনকি সম্পত্তির মালিকদের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ উঠেছিল।
মূলত, এই ধারণা সবসময় “অন্যের প্রতি রাগ বা বিরোধিতা” প্রকাশের এক রূপ—থিয়েলের ক্ষেত্রে তা হলো AI–বিরোধী নিয়ন্ত্রণের প্রতি অসন্তোষ।
অশুভের প্রতি আকর্ষণ ও প্রচারণা
অ্যান্টিক্রাইস্টের ধারণা জনপ্রিয় কারণ, শয়তানের আকর্ষণ প্রায়শই ঈশ্বরের মহিমাকেও ছাপিয়ে যায়। জন মিলটনের মতো কবিরাও অনিচ্ছাকৃতভাবে “শয়তানের দলে পড়ে গেছেন” বলে ধারণা করা হয়।
থিয়েল জানেন, ‘AI নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি’ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা তেমন সাড়া পেত না, তাই তিনি সেটিকে গোপন বক্তৃতা আকারে উপস্থাপন করে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ শব্দটি যোগ করেছেন—একটি “চমৎকার বিপণন কৌশল” হিসেবে।
অপ্রমাণযোগ্য অভিযোগ ও আধুনিক বিভ্রান্তি
অ্যান্টিক্রাইস্ট–সম্পর্কিত অভিযোগ প্রমাণ করা যেমন কঠিন, তেমনি খণ্ডনও অসম্ভব। বোস্ট্রম নিজে বলেছেন, “আমি ক্যামেরা বন্ধ করলে কী করি, আপনি জানেন না”—এমন হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন।
একসময় ইউরোপীয় চিন্তাধারা যুক্তিবাদ ও আলোকায়নের প্রভাবে অশুভ শক্তির ধারণা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে আবার “Antichrist” শব্দটির ব্যবহার বাড়ছে, যা হয়তো প্রমাণ করছে—আমরা এক “বিরুদ্ধ-আলোকায়ন” যুগে প্রবেশ করেছি।
থিয়েলের বক্তব্য ধর্ম, প্রযুক্তি ও রাজনীতির জটিল সংমিশ্রণ তুলে ধরে। এটি একদিকে সিলিকন ভ্যালির আত্ম-আলোচনার অংশ, অন্যদিকে মানব সভ্যতার গভীরে লুকানো ভয় ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতিফলন। হয়তো অ্যান্টিক্রাইস্ট ফিরে আসেনি, কিন্তু তাঁকে ঘিরে নতুন এক প্রজন্মের উদ্বেগ ও প্রচারণা নিশ্চিতভাবেই ফিরে এসেছে।
# পিটার_থিয়েল,# অ্যান্টিক্রাইস্ট, #সিলিকন_ভ্যালি, বাইবেল, #কৃত্রিম_বুদ্ধিমত্তা, #গ্রেটা_থানবার্গ, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















