দুই মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি—অবসরপ্রাপ্ত অ্যান্থনি কেনেডি ও বর্তমান বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট—সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁদের স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন এক উদ্বেগজনক চিত্র। তাঁদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসন আজ এক গভীর সংকটে পড়েছে; যেখানে আদালতের স্বাধীনতা ও বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা রাজনৈতিক ক্ষমতার চাপে ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।
কেনেডির অভিজ্ঞতা: পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও এক অশুভ ধারণা
২০০১ সালে রাশিয়া সফরে গিয়ে বিচারপতি অ্যান্থনি কেনেডি তিনটি ঘটনায় বিচলিত হন। প্রথমত, তাঁর গাড়ি থামিয়ে ঘুষ দাবি করে রুশ পুলিশ। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় বিচারকরা জিজ্ঞেস করেন—আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কীভাবে গোপনে বিচারকদের রায় নির্ধারণ করেন। কেনেডির উত্তরে—“এমন কোনো ব্যবস্থা নেই”—তাঁরা অবিশ্বাস প্রকাশ করেন। তৃতীয় ঘটনায় তিনি সাক্ষাৎ করেন ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও, পুতিন পরে বলেন, “হত্যাকারীদের আমি নিজ হাতে গলা টিপে মারতে পারি।” সেখানেই কেনেডি উপলব্ধি করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট নিজের ইচ্ছাকেই আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন।
‘লাইফ, ল’ অ্যান্ড লিবার্টি’: কেনেডির নতুন আত্মজীবনী
রোনাল্ড রিগানের আমলে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ পান কেনেডি। অবসর নেন ২০১৮ সালে। তাঁর দেওয়া অন্যতম ঐতিহাসিক রায়—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমলিঙ্গ বিবাহকে বৈধ ঘোষণা। কিন্তু নতুন বই Life, Law & Liberty-তে তিনি স্পষ্ট করেন, আজ যুক্তরাষ্ট্রেও আইনের শাসন বিপদের মুখে। পুতিনের ধারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে—চীন, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, এল সালভাদর থেকে জিম্বাবুয়ে পর্যন্ত—যেখানে ক্ষমতাবানরা নিজেদের ঊর্ধ্বে আইনকে রাখেন না।

ট্রাম্প প্রশাসনের বিতর্কিত ক্ষমতা প্রয়োগ
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এই প্রবণতা আমেরিকাতেও দৃশ্যমান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই তিনি মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে “যুদ্ধ ঘোষণা” করতে পারেন এবং সন্দেহভাজনদের নৌকায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হত্যা করতে পারেন। এমনকি তিনি প্রতিবাদকারীদের ‘সশস্ত্র বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠানোর অনুমতিও দিয়েছেন।
৪ অক্টোবর এক ফেডারেল বিচারক এই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান স্টিফেন মিলার তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ বলে অভিযুক্ত করেন।
বিচারকদের ওপর ভয় ও হুমকি
মার্কিন বিচারকদের নিরাপত্তা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। ইউএস মার্শাল সার্ভিসের তথ্যমতে, শুধু ২০২৫ সালেই ৩৯৫ জন বিচারক হুমকি পেয়েছেন। হুমকি এসেছে রাজনৈতিক বাম ও ডান উভয় দিক থেকেই। উদাহরণস্বরূপ, ৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়া এক ব্যক্তি বিচারপতি ব্রেট ক্যাভানাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। আবার ট্রাম্পের সমর্থক চরম ডানপন্থীরা এমন বিচারকদের ‘দেশদ্রোহী’ বলছেন, যারা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
অ্যামি কোনি ব্যারেটের স্মৃতিকথা: ‘লিসেনিং টু দ্য ল’
ট্রাম্প নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের বই Listening to the Law প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন মৃত্যুর হুমকি ও অশালীন পার্সেল পাওয়ার কথা। ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলায় অংশ নেওয়া এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে বলে হুমকি দিয়েছিল, “কেউ যেন ব্যারেটের গলা কেটে দেয়।” এমনকি তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতেও বারবার ‘পিজা’ পাঠিয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। ফলে তিনি আজ বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরেন ও পূর্ণকালীন নিরাপত্তা রক্ষী রাখেন।
ট্রাম্প প্রসঙ্গে নীরবতা
অদ্ভুতভাবে দুই বইতেই ট্রাম্পের নাম খুব কমই এসেছে। ৬০০ পৃষ্ঠারও বেশি লেখায় তাঁকে সরাসরি সমালোচনা করা হয়নি। ব্যারেট হয়তো নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চেয়েছেন, কারণ আগামী বছরগুলোতেও তাঁকে ট্রাম্প–সম্পর্কিত মামলা শুনতে হতে পারে। কিন্তু কেনেডি অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁর লেখায় ট্রাম্পের প্রতি নীরব প্রতিবাদের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
কেনেডির নৈতিক অবস্থান ও সমালোচনা
কেনেডি উল্লেখ করেছেন, তাঁর স্ত্রী কখনো এমন কোনো সরকারি চাকরি নেননি যা তাঁর বিচারিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। অথচ ট্রাম্প পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতায় থেকেই, ব্যবসায়িকভাবে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করেছেন। তিনি লিখেছেন, “কারাগারগুলো মানবিক ও পুনর্বাসনকেন্দ্র হওয়া উচিত”—যার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসন এল সালভাদরের বন্দিদের বিচার ছাড়াই আটক করে রাখছে এবং সেই ভয়াবহ দৃশ্য প্রচার করছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কেনেডির অবস্থান
কেনেডি বলেন, “যদি শ্রোতার আবেগ আঘাত পাওয়াকে, বাকস্বাধীনতার সীমা ধরা হয়, তবে স্বাধীনতা মানে শুধু এমন কথা বলা যা কারও খারাপ না লাগে।” তিনি পতাকা পোড়ানো নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা করে বলেন, “পতাকাই রক্ষা করে তাঁদেরকেও, যারা সেটিকে অবজ্ঞা করে।” অথচ ট্রাম্প প্রশাসন পতাকা পোড়ানোকে অপরাধ ঘোষণার পথে হাঁটছে।
ভদ্রতা ও আত্মসংযমের আহ্বান
কেনেডি লিখেছেন, “জাতীয় টেলিভিশনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অশোভন ভাষা ব্যবহার করা লজ্জাজনক।” তাঁর মতে, জনসম্মুখে অপমানমূলক আচরণ এক ধরনের আত্মমুগ্ধতার লক্ষণ। “যারা অন্যকে হেয় করে আনন্দ পায়, তারা মানসিকভাবে বিকৃত নয়তো অন্তত সেই রকমই আচরণ করে।”
আদালতের নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ভারসাম্য
সবশেষে কেনেডি ও ব্যারেট উভয়েই আদালতের নিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন। ব্যারেট লিখেছেন, “একজন বিচারক না ডেমোক্র্যাট, না রিপাবলিকান—তিনি কোনো দল বা প্রশাসনের কাছে দায়বদ্ধ নন।”
কেনেডি আরও সরাসরি সতর্ক করেন, “গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না, যদি কেউ ক্ষমতায় লেগে থাকে তার সময়সীমার বাইরে।” তাঁর বক্তব্যে সুপ্ত ইঙ্গিত স্পষ্ট—আইনের শাসন যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার নিচে নত হয়, তখন গণতন্ত্র নিজেই তার আত্মা হারায়।
# যুক্তরাষ্ট্র,# সুপ্রিম কোর্ট, #অ্যান্থনি কেনেডি, #অ্যামি কোনি ব্যারেট, #ট্রাম্প প্রশাসন,# আইনের শাসন, #গণতন্ত্র সংকট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















