অ্যান্ড্রু রস সারকিন তাঁর নতুন গ্রন্থ ‘১৯২৯’-এ তুলে ধরেছেন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের গল্প—একটি ধস, যা শুধু বাজার নয়, গোটা আমেরিকান সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০৮ সালের সংকট নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ‘Too Big to Fail’-এর পর এবার তিনি ফিরে গেছেন সময়ের চাকা ঘুরিয়ে সেই ঐতিহাসিক শেয়ারের ধসের দিকে, যার সঙ্গে পরবর্তী প্রতিটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের তুলনা আজও করা হয়।
শেয়ারবাজারের উন্মাদনা ও পতনের সূত্রপাত
১৯২০-এর দশকে আমেরিকার শেয়ারবাজার ছিল আশ্চর্যরকম দ্রুত বর্ধনশীল—১৯২১ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে প্রায় ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায় সূচক। সেই উল্লম্ফনের পেছনে ছিল অতিরিক্ত আশাবাদ ও ঋণনির্ভর বিনিয়োগ। ১৯২৯ সালের অক্টোবরে বাজারে সেই ঋণচক্রই বিস্ফোরিত হয়; বিনিয়োগকারীদের লিভারেজ করা পুঁজি মুহূর্তে ভস্মীভূত হয়। পরবর্তী দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই ধস অবশেষে বিশ্বব্যাপী ‘মহামন্দা’-য় রূপ নেয়, যা স্থায়ী হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত।
ডাও জোন্স সূচক ১৯৫৪ সালের আগে আর কখনও ১৯২৯ সালের উচ্চতায় ফিরে যেতে পারেনি।
লামন্ট ও মিচেল: বিপর্যয়ের মুখোমুখি দুই নায়ক
সারকিন তাঁর বর্ণনায় ফোকাস রেখেছেন দুজন প্রধান চরিত্রে—জে.পি. মরগানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান থমাস লামন্ট ও ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের প্রধান চার্লস ‘সানশাইন চার্লি’ মিচেল। তাঁরা শুধু ব্যাংকারই ছিলেন না; ছিলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
যখন বাজার ধসে পড়ে, আমেরিকার ব্যাংকগুলো শেয়ার ব্যবসায়ীদের বিপুল ঋণ দিয়ে রেখেছিল, যারা আবার নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছে সেই অর্থ ধার দিয়েছিল। দাম পড়তে শুরু করলে এই ঋণচেইন ভেঙে যায়। লামন্টের নেতৃত্বে কয়েকটি ব্যাংক শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে বাজারকে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। কিন্তু তা শুধু ক্ষতির মাত্রা বাড়ায়।
এরপর সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা তাঁদেরকে দায়ী করতে শুরু করে। কংগ্রেসে তাঁদের হাজির করা হয়, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালে গ্লাস–স্টিগল আইন পাস হয়, যা বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং কার্যক্রমকে পৃথক করে দেয়।
ইতিহাসের জীবন্ত পুনর্নির্মাণ
২০০৮ সালের সংকট নিয়ে সারকিন শত শত সাক্ষাৎকার করেছিলেন। কিন্তু ১৯২৯ সালের এই বইয়ে তিনি ইতিহাসের নথিপত্র, সাক্ষ্য ও চিঠিপত্র ঘেঁটে তৈরি করেছেন এক জীবন্ত বয়ান। পাঠকের কাছে ঘটনাগুলো যেন একেবারে আজকের মতোই বাস্তব মনে হয়।
বইটিতে তিনি ঐ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদেরও যুক্ত করেছেন—যেমন রাইখসব্যাংকের প্রধান হ্যালমার শাখট, যিনি জার্মানির যুদ্ধ reparations ও মুদ্রাস্ফীতি সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন, এবং ব্রিটিশ নেতা উইনস্টন চার্চিল, যিনি নিজেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন ও “ব্ল্যাক টিউজডে”-র দিন নিউইয়র্কে উপস্থিত ছিলেন।
১৯২৯ থেকে ২০২৫: মিল ও সতর্কবার্তা
সারকিন সরাসরি তুলনা টানেননি, তবে পাঠকের কাছে ১৯২৯ ও ২০২৫ সালের মধ্যে কিছু অস্বস্তিকর মিল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯২০-এর শেষ দিকে যেমন কিস্তিভিত্তিক ক্রেডিট—আজকের “বাই নাউ, পে লেটার” ব্যবস্থার পূর্বসূরি—প্রচলিত হয়েছিল, তেমনি এখনো আমেরিকায় ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
তখন বিনিয়োগ ছিল সাধারণ মানুষের জাতীয় বিনোদন, আর আজও শেয়ারবাজারে অংশ নিচ্ছে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, যাদের অনেকেই ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছে। মার্জিন ঋণের পরিমাণ এখন আবারও অর্থনীতির তুলনায় রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে—একটি বিপজ্জনক পূর্বাভাস।
ধসের পর পুনরুত্থানের শিক্ষা
১৯২৯ সালের উল্লাস, আতঙ্ক ও নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্তি—সবই যেন আধুনিক যুগের প্রতিধ্বনি। তবে সারকিনের বার্তা আশাবাদী। ইতিহাস বলছে, সবচেয়ে অন্ধকার সময়ও কেটে যায়।
উইনস্টন চার্চিলের মন্তব্যে সেই বার্তাই প্রতিফলিত: “আমেরিকান জল্পনা যন্ত্রের অন্তর্নিহিত সততা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে ব্রিটিশ সমালোচককে জানা উচিত। এটি সংকট ঠেকাতে নয়, বরং তা থেকে টিকে উঠতে নির্মিত।”
অ্যান্ড্রু রস সারকিনের ‘১৯২৯’ কেবল এক আর্থিক বিপর্যয়ের কাহিনি নয়; এটি মানবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ভয় ও পুনরুদ্ধারের গল্প। প্রায় এক শতাব্দী আগের ধস আজও মনে করিয়ে দেয়—অর্থনৈতিক চক্রের ভেতর যতই দোলাচল আসুক, ধৈর্য ও সংস্কারই টিকে থাকার চাবিকাঠি।
# ১৯২৯_বাজার_ধস, #অ্যান্ড্রু_রস_সারকিন,# আমেরি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















