চীনের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ সাইলেন্ট অনার–এ তুলে ধরা হয়েছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) গোপন এজেন্ট উউ শির জীবনকাহিনি। তার বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজন্মের মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। বেইজিংয়ের ফুত্যান সমাধিক্ষেত্রে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তার কবর পরিদর্শনে যাচ্ছেন—একজন নীরব নায়কের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, যাকে তারা বলছেন “মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না”।
নীরব নায়কের প্রতি জনতার শ্রদ্ধা
বেইজিংয়ের ফুত্যান সমাধিক্ষেত্রের কর্মীরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি টিভি সিরিজটি প্রচারের পর থেকেই দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ দর্শনার্থী আসছেন কেবল উউ শি ও তার স্ত্রী ওয়াং বিকুইয়ের কবরের সামনে শ্রদ্ধা জানাতে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও কেউ থামছেন না। কেউ ফুল পাঠাচ্ছেন দূর থেকে, কেউ আবার উউ শির জন্মস্থান ফুজিয়ান প্রদেশের বিশেষ চা নিয়ে আসছেন সম্মান জানাতে।
বীরত্বের অনুপ্রেরণায় প্রবীণদের শ্রদ্ধা
দুই প্রবীণ যোদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে একে অপরকে সহায়তা করে এসে কবরের সামনে মাথা নত করেন। তাদের একজন মেই ফু সিয়াং, যিনি আশির কোঠায় এবং একসময় গোপন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন, বলেন—“সত্যিকারের বীররা কখনো ভোলা যায় না।”
অন্যজন, যিনি উউ পদবিধারী, বলেন—“উউ শি চাইলে মূল ভূখণ্ডে আরামে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিপদের পথ, কারণ তিনি চাইতেন সংঘাত দ্রুত শেষ হোক।”
উউ শির গোপন মিশন ও আত্মত্যাগ
১৯৫০ সালের জুনে তাইওয়ানে গোপনে কাজ করছিলেন উউ শি। ১০ মাসের মাথায় সহকর্মী কাই শিয়াওচিয়ানের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ধরা পড়েন। প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি। এক চোখের দৃষ্টি হারানোর পরও তার মনোবল ছিল অবিচল। শেষ পর্যন্ত ৫৭ বছর বয়সে তিনি তাইপের মাচাংটিং এলাকায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

তার মৃত্যুর পর এক আত্মীয় উ ইয়িনসিয়ান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করে তাইপের উপকণ্ঠের একটি মন্দিরে রাখেন। সেখানে তিন দশকেরও বেশি সময় তার দেহাবশেষ ছিল অনাদরে।
১৯৯১ সালে উউ শির মেয়ে উ শুয়েচেং ও জামাতা সেই দেহাবশেষ চীনের হেনান প্রদেশের ঝেংঝৌ শহরে নিয়ে আসেন। ১৯৯৩ সালে স্ত্রী ওয়াং বিকুই মারা যান যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের ছোট ছেলে উ জিয়ানচেং তার দেহাবশেষ নিয়ে আসেন চীনে। পরের বছর, ১৯৯৪ সালের বসন্তে, এই দম্পতিকে একসঙ্গে সমাহিত করা হয় ফুত্যান সমাধিক্ষেত্রে।
টিভি সিরিজ ও তাইওয়ানকে ঘিরে প্রতিক্রিয়া
হংকংয়ের সিং তাও ডেইলি লিখেছে, চীনের আগে অনেক গুপ্তচরভিত্তিক সিরিজ নির্মিত হয়েছে—যেমন লার্ক ও কাইট—কিন্তু সাইলেন্ট অনার প্রথমবার তাইওয়ান প্রেক্ষাপটে এই ইতিহাস দেখিয়েছে। এটি “উউ শি কেস”-কে নতুন প্রজন্মের সামনে জীবন্ত করে তুলেছে।
তাইওয়ানের কিছু গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে, এই সিরিজে প্রকৃত নাম ও ঘটনার ব্যবহার বিরল, যা ইঙ্গিত দেয়—চীন হয়তো তাইওয়ানের জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচারণাকে জোরদার করছে।

রাষ্ট্রীয় পরিষদের তাইওয়ান বিষয়ক দপ্তরের মুখপাত্র চেন বিনহুয়া বলেছেন, শহীদদের অটল বিশ্বাস দুই প্রান্তের মানুষকে জাতীয় পুনর্মিলনের পথে অনুপ্রাণিত করবে।
বেইজিংয়ে ‘অজানা বীরদের স্মৃতি চত্বর’
ফুত্যান ছাড়াও, উউ শি ও তার সহযোদ্ধা ঝু ফেং, নিয় শি–সহ বহু অজ্ঞাত বীরের স্মরণে বেইজিংয়ের শিসান ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্কে নির্মিত হয়েছে ‘অজানা বীরদের স্মৃতি চত্বর’।
বেইজিংয়ের দাসিং জেলার দম্পতি ওয়াং ইউয়ে ও জেং ইয়ান প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বৃষ্টির মধ্যেও সেখানে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। তারা বলেন—“এই সিরিজ দেখতে গিয়ে প্রতিটি দৃশ্যে মনে হচ্ছিল আমরা সুখে বসে আছি, অথচ তারা মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন সাহসের সঙ্গে।”
অজানা বীরদের নাম লেখা দেয়াল
স্মৃতি চত্বরের দেয়ালে খোদাই করা রয়েছে ৮৪৬ জন শহীদের নাম। এখনও ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে—যেন ভবিষ্যতে নতুন কোনো বীরের নাম পাওয়া গেলে তা যোগ করা যায়।
নানজিং-এর বাসিন্দা ওয়াং নামের এক দর্শনার্থী বলেন—“মাতৃভূমি একবার পুনর্মিলিত হলে, প্রতিটি বীরের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে।”
অন্য এক নারী, ওয়াং ফেংইউ, যিনি মহাকাশ খাতে কর্মরত, বলেন—“আমি আগে এই ইতিহাস জানতাম না। এখন জানি, তাই এসেছি সম্মান জানাতে। আমাদের দেশ এক হবে, তাহলেই তারা শান্তিতে বিশ্রাম নেবেন।”
‘মাদারল্যান্ড কখনো ভোলে না’
চীনের মহাকাশ গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছেন, যাদের সম্মান জানাতে রচিত হয়েছে গান দ্য মাদারল্যান্ড উইল নেভার ফরগেট।
বৃষ্টিভেজা বিকেলে যখন প্রতিবেদক পাহাড় থেকে নামছিলেন, একজন মানুষ একা দাঁড়িয়ে ছিলেন—চোখে জল, ঠোঁটে সেই গান। তিনি বললেন, “আমার অনুভূতিকে চারটি কথায় বলা যায়—গৌরবে নামহীন, ত্যাগে নিঃস্বার্থ, যুদ্ধে অদৃশ্য, সম্মানে অনন্য।”
তার চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে গেল—যেন জলের ফোঁটা ফিরে গেল সমুদ্রে, যেমন এক দ্বীপ ফিরে যায় মাতৃভূমিতে।
#চীন, উউ শি, সাইলেন্ট অনার, তাইওয়ান, জাতীয় পুনর্মিলন, সিপিসি, শহীদ স্মৃতি
 
																			 সারাক্ষণ রিপোর্ট
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 


















