বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় যোদ্ধা
চার্লস সি. “চার্লি” ডিগস জুনিয়র ছিলেন এমন এক মার্কিন রাজনীতিক, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে বর্ণবৈষম্য ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ডেট্রয়েট শহর থেকে নির্বাচিত এই কৃষ্ণাঙ্গ কংগ্রেসম্যান ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক মেরিয়ন অর তাঁর জীবনী “হাউস অব ডিগস”-এ এই বিতর্কিত কিন্তু প্রভাবশালী নেতার জীবনের উত্থান ও পতন তুলে ধরেছেন।
পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
১৯২২ সালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যবসায়ী এক পরিবারে জন্ম নেন ডিগস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দক্ষিণের সামরিক ঘাঁটিতে তিনি বর্ণবৈষম্যের তীব্র অভিজ্ঞতা পান। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে মিশিগানের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট সিনেটর হন, কিন্তু ঘুষের অভিযোগে পদ হারান। সেই আসনই পরে পুত্র ডিগস জয় করে মাত্র ২৯ বছর বয়সে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

১৯৫৪ সালে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৫৫ সালে তিনি দায়িত্ব নেন। সে সময় তিনি মাত্র তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ কংগ্রেসম্যানের একজন ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় সরাসরি যুক্ত হন—বিশেষ করে এমেট টিল হত্যাকাণ্ডের বিচার ও মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
কংগ্রেসে নিরলস সংগ্রামী
ডিগস বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে একনিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সব শাখায় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। তাঁর সহকর্মী অ্যাডাম ক্লেটন পাওয়েল হয়তো জনসমক্ষে বেশি পরিচিত ছিলেন, কিন্তু অর-এর মতে, কংগ্রেসে ডিগসই “নীরবে অনেক বেশি কাজ সম্পন্ন করেছেন।”
তবে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সব সময় সবার পছন্দ হয়নি। ১৯৬৩ সালে মিসিসিপির ক্লার্কসডেলে বর্ণবাদবিরোধী কর্মী অ্যারন হেনরির বাড়িতে অবস্থানকালে একদল সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালায়। এক বছর পর ১৯৬৪ সালে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে মিসিসিপির কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধিদের আসনচ্যুতি’র বিরোধিতা না করে বরং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের সঙ্গে সমঝোতা করেন ডিগস। এতে হেনরি ও তাঁর সহযোদ্ধারা গভীরভাবে হতাশ হন।
প্রতিবাদ থেকে রাজনীতিতে—এক পরিবর্তনের প্রতীক
অর-এর মতে, ডিগস ছিলেন সেই রূপান্তরের প্রতীক, যা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা বায়ার্ড রাসটিন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “ফ্রম প্রোটেস্ট টু পলিটিকস”-এ ব্যাখ্যা করেছিলেন। আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের রাজনীতিতে উত্তরণের পথে ডিগস ছিলেন এক কৌশলগত, মাঝারি ধারা-অনুসারী রাজনীতিক।

আফ্রিকা–মুখী দৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
ডিগসের রাজনীতি কেবল আমেরিকান সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল না। আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলন ও বর্ণবৈষম্যবিরোধী রাজনীতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি কংগ্রেসের অন্য যে কোনো সদস্যের চেয়ে বেশি বার আফ্রিকা সফর করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আফ্রিকা বিষয়ক উপকমিটির প্রধান হন এবং ১৯৭৩ সালে ডিস্ট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রাজধানী ওয়াশিংটনের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে নেতৃত্ব দেন।
ব্যক্তিগত বিপর্যয় ও কেলেঙ্কারি
১৯৬৭ সালে তাঁর পিতার আত্মহত্যার পর পারিবারিক ব্যবসা ‘হাউস অব ডিগস’ ধসে পড়ে। ব্যবসার তহবিল থেকে ব্যক্তিগত খরচ চালানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সাংবাদিক সাইমন বুকারের লেখায় উঠে এসেছে, জুয়া খেলার আসক্তি তাঁকে আর্থিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
১৯৭৭ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করে যে, ডিগস কর্মচারীদের বেতন থেকে ঘুষ নিচ্ছেন। তদন্তে প্রমাণিত হয়, তিনি বেতন তালিকা জালিয়াতি ও মিথ্যা বিবৃতির ২৯টি মামলায় দোষী। যদিও পরের নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হন, ১৯৮০ সালে আপিল শেষ হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন এবং সাত মাস কারাভোগ করেন।

ইতিহাসের রায়
১৯৯৮ সালে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় ডিগসের চারজন স্ত্রীই তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন। মেরিয়ন অর-এর বইতে ডিগসের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নির্মোহভাবে চিত্রিত হলেও লেখক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি ছিলেন “সবচেয়ে প্রভাবশালী কৃষ্ণাঙ্গ ফেডারেল আইনপ্রণেতা।” তাঁর ব্যক্তিগত দুর্বলতা যেমন তাঁর পতন ডেকে এনেছে, তেমনি তাঁর রাজনৈতিক সাফল্য আজও আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
#চার্লস_ডিগস,# যুক্তরাষ্ট্র_#কংগ্রেস, #বর্ণবৈষম্য, #নাগরিক_অধিকার_#আন্দোলন,# হাউস_অব_ডিগস,# মেরিয়ন_অর,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















