জাম্বিয়ার কপারবেল্ট প্রদেশের কালুসালে গ্রামে চীনা মালিকানাধীন তামার খনির দেয়াল ভেঙে বিষাক্ত বর্জ্যপানি ছড়িয়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি ও নদী তিন বছর পর্যন্ত অচাষযোগ্য হয়ে গেছে। স্থানীয়দের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে কোম্পানি শর্ত দিয়েছে—“চুপ থাকতে হবে।”
জাম্বিয়ার কালুসালে ভয়াবহ দিন
জাম্বিয়ার কালুসালে গ্রামের বাসিন্দা বাথশেবা মুসোলের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিনটি শুরু হয়েছিল এক প্রচণ্ড শব্দে। চীনা মালিকানাধীন এক তামার খনির ৩০ ফুট উঁচু দেয়াল ভেঙে পড়লে বিষাক্ত বর্জ্যের পুল ফেটে গিয়ে তার গ্রাম ও ক্ষেত-খামারে ছড়িয়ে পড়ে হলদে দুর্গন্ধযুক্ত তরল। সেই স্রোত ভেসে নিয়ে যায় তার ভুট্টার ক্ষেত—যেখান থেকে তিনি আট সন্তানকে খাওয়াতেন। পানি বুক পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল, মুসোলে বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এবার বোধহয় ডুবে মরব।”
ফেব্রুয়ারি ১৮ তারিখে ঘটে এই দুর্ঘটনা। মাস কয়েক পর আগস্টে ‘সিনো মেটালস’—চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ‘চায়না ননফেরাস মাইনিং কর্পোরেশন’-এর একটি ইউনিট—তার ক্ষেতে হাজির হয়। সরকারের মূল্যায়ন অনুযায়ী, জমিটি অন্তত তিন বছর পর্যন্ত ফসল ফলানোর উপযোগী থাকবে না।

ক্ষতিপূরণে শর্ত: চুপ থাকতে হবে
কোম্পানির কর্মকর্তারা এসে বলেন, “সব ঠিক করে দেওয়া হবে।” কিন্তু প্রস্তাব ছিল মাত্র ১৫০ ডলারের, তাও এক শর্তে — মুসোলে যেন কখনো এই দুর্ঘটনার বিষয়ে কথা না বলেন, আইনি পদক্ষেপ না নেন, এমনকি চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশও না করেন। স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের মতে, একই শর্ত সব ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল।
ক্ষেতে কিছুই অবশিষ্ট না থাকায় মুসোলে শর্ত মেনে নেন। বিনিময়ে তিনি মাসে ১১ পাউন্ড কর্নমিল পান, যা স্থানীয় খাদ্যের প্রধান উপাদান। “কমপক্ষে খাওয়ার কিছু তো আছে,” তিনি বলেন। “এখানকার মানুষ এখন চীনা কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করতে ক্লান্ত।”
আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগের প্রভাব
গত ২৫ বছরে চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকায় বন্দরের পাশাপাশি রেললাইন, সড়ক, স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর ও হাসপাতাল নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। শুধু ২০২৩ সালেই আফ্রিকার খনিখাতে চীনের বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৮.৭ বিলিয়ন ডলার—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
এই বিপুল বিনিয়োগ আফ্রিকায় চীনকে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র তার বিদেশি সহায়তা কমাচ্ছে এবং রাশিয়া মহাদেশে ভাড়াটে সেনা পাঠাচ্ছে। কিন্তু জাম্বিয়ার কপারবেল্ট প্রদেশে এই খনি দুর্ঘটনা সেই প্রভাবের বিতর্কিত দিকও তুলে ধরেছে।
অভিযোগ: ‘অমানবিক’ আচরণ ও প্রতারণামূলক চুক্তি
ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আইনজীবী ব্রিগেডিয়ার সিয়াচিটেমা বলেন, “চীনা কোম্পানির কর্মকর্তারা খুবই অমানবিক আচরণ করেছেন। মানুষকে কত টাকা দেওয়া হবে, তা তাদের জানানোই হয়নি—চুক্তিতে সই করার পরেই তারা জানতে পারে।”

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খনি কোম্পানিটি দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করেছে এবং জাম্বিয়া সরকারের সঙ্গে মিলে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কোম্পানি দাবি করে, ভারী বৃষ্টিপাত ও স্থানীয়দের অবৈধ কর্মকাণ্ডে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা আরও জানায়, সরকারের মূল্যায়ন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে এবং পরিবেশে ‘গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রভাব পড়েনি’।
পুরনো ক্ষোভ, নির্ভরতার রাজনীতি
চীনা বিনিয়োগের কারণে জাম্বিয়া অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা নির্ভরশীল। দেশটির খনি শুল্ক আয় বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার, যার বেশিরভাগই চীনা কোম্পানি থেকে আসে। উৎপাদিত তামার অর্ধেক রপ্তানি হয় চীনে। আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে চীনা কোম্পানিগুলোর নতুন ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনাও রয়েছে।
কিন্তু দুই দশক আগেই একই খনিতে এক বিস্ফোরণে ৪৬ শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশ দূষণের অভিযোগে আরও দুটি চীনা খনি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি হাকাইনদে হিচিলেমা, যিনি আগামী বছর পুনর্নির্বাচনের চেষ্টা করছেন, বর্তমানে চীনের কাছে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পুনর্গঠনের আলোচনায় রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ কারণেই সরকার ‘সিনো মেটালস’-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারছে না।
বিষাক্ত বর্জ্যে নদী–জমি ধ্বংস
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জানায়, কপারবেল্টের এই দুর্ঘটনাটি ইতিহাসের ছয় নম্বর বৃহৎ খনি-বর্জ্য দুর্ঘটনা। বিষাক্ত কাদা প্রবাহিত হয়ে কাফুয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে—প্রায় ৭০ মাইল জুড়ে মাছ মরে যায়, কৃষিজমি নষ্ট হয়।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দূষিত পানি পান করে কপারবেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডজন ডজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে; বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাইকেল গঞ্জালেস এক অভ্যন্তরীণ ইমেইলে লেখেন, “১৭০ টিরও বেশি পানি ও মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে—সিনো মেটালসের মতো অনুতাপহীন ও দায়স্বরূপ কোম্পানি তারা কখনো দেখেনি।”
ক্ষতিপূরণ ও আইনি লড়াই
প্রাথমিকভাবে কোম্পানি প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য নদীতে পৌঁছানোর কথা স্বীকার করলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশ সংস্থা ড্রিজিট এনভায়রনমেন্টাল তদন্তে জানায়, প্রকৃত পরিমাণ ছিল ১.৫ লাখ টন—কোম্পানির দাবি থেকে ৩০ গুণ বেশি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগের দিনই সিনো মেটালস তাদের চুক্তি বাতিল করে দেয়।
সরকার জানিয়েছে, চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ও পরিসর নির্ধারণে স্বাধীন মূল্যায়ন করা হবে। তবে ইতিমধ্যে কোম্পানি ৬.৫ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে অনেক ক্ষতিগ্রস্তকে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১০০ ডলার করে।
মৎস্যচাষি টিমি কাবিন্ডেলা বলেন, “আমার ৮০ বছর বয়সী মাকে জোর করে এমন এক কাগজে সই করানো হয়, যা তিনি বুঝতেই পারেননি।” তিনি এখন আদালতে মামলা লড়ছেন, ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
ভয়, নিপীড়ন ও ‘নীরবতার পুলিশি অভিযান’
স্থানীয় কাউন্সিল সদস্য স্যামুয়েল সেকান্যা বলেন, “চীনারা শুধু দেখানোর জন্য কাজ করছে। তারা মানুষকে এমন কাগজে সই করাচ্ছে যা তারা পড়তেও পারে না।”

অভিযোগ উঠেছে, কোম্পানি স্থানীয়দের সংবাদমাধ্যম বা পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধা দিচ্ছে। কালুসালে গ্রামে পুলিশ সাংবাদিক ও বাসিন্দাদের ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়।
একবার কোম্পানির ড্রোনে পরিবেশকর্মীদের দেখা গেলে পুলিশ এসে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে তাদের মধ্যে ২৫ বছর বয়সী সাকানি সারা-ও ছিলেন। তাকে “অকারণে অবস্থান” অভিযোগে এক রাত আটক রেখে ১০ ডলার জরিমানা করে মুক্তি দেওয়া হয়।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, গত তিন মাসে এক ডজনের বেশি সাংবাদিক ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা করা গ্রামবাসী পন্ডে চুলু জানান, পুলিশি হয়রানি এড়াতে তিনি লুকিয়ে আছেন। “আমি দূষণের শিকার হয়েছি,” তিনি বলেন, “তবু বাঁচতে হলে পুলিশের হাত থেকেও লুকাতে হয়।”
# চীন,# জাম্বিয়া,# খনি দুর্ঘটনা,# পরিবেশ দূষণ, #ক্ষতিপূরণ, #মানবাধিকার,# আফ্রিকা, #সিনো মেটালস,# আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















