শতাব্দীর পুরোনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু অভিযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সংক্ষিপ্ততম জলপথ খুঁজতে গিয়ে—যে পথ বরফে ঢাকা কানাডার আর্কটিক দ্বীপমালার মধ্য দিয়ে যায়। সেই কিংবদন্তি পথ, ‘নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ’, আজ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গলতে থাকা বরফের কারণে প্রতি বছর কয়েক মাসের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এখন সেখানে বিলাসবহুল ক্রুজ জাহাজে করে হাজারো পর্যটক ভিড় জমাচ্ছেন।
এ বছর অন্তত নয়টি ক্রুজ জাহাজ থামবে কানাডার ইনুইট জনগোষ্ঠীর বসতি গজোয়া হেভেনে। স্থানীয় মেয়র রেমন্ড কুকশুন বলেন, “নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ আমাদের ভূমি ও জীবনের অংশ।”
সার্বভৌমত্ব নিয়ে উত্তেজনা
এই নতুন জলপথকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। কানাডা দাবি করছে, পুরো প্যাসেজ তাদের সার্বভৌম জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ একে আন্তর্জাতিক জলপথ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যদিও এটি কানাডার নুনাভাট অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, যেখানে প্রধানত ইনুইট জনগোষ্ঠী বসবাস করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্কটিকের বরফ দ্রুত গলছে, আর এর সঙ্গে উন্মোচিত হচ্ছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত সম্ভাবনা—যা নতুন করে জাগাচ্ছে মহাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অনেকটা ঠান্ডা যুদ্ধ–পরবর্তী উত্তেজনার মতো।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের নতুন চাল
রাশিয়া ইতিমধ্যে আর্কটিকে সামরিক অবস্থান জোরদার করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বাড়িয়েছে। চীন নিজেকে “নিকট-আর্কটিক রাষ্ট্র” হিসেবে বর্ণনা করছে এবং বাণিজ্য ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে সম্প্রসারণ করছে।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে কানাডা অধিগ্রহণের হুমকি দিয়েছেন এবং গ্রীনল্যান্ড কেনার কথাও বলেছেন। তিনি আর্কটিক অঞ্চলে ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের “গোল্ডেন ডোম” ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঢাল নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
কানাডার পাল্টা প্রস্তুতি
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ঘোষণা দিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই হবে দেশের সবচেয়ে বড় সামরিক ব্যয়ের বৃদ্ধি। তার সরকারের লক্ষ্য—আর্কটিক অঞ্চলে অবকাঠামো ও সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করা।
তবে এই প্রচেষ্টা সফল করতে হলে ইনুইট জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা অপরিহার্য। কানাডা সরকারও তাদের দীর্ঘদিনের উপস্থিতিকে আইনি ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আর্কটিকের ওপর সার্বভৌমত্ব দাবি করে, যা “ঐতিহাসিক অধিকারের” ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ইনুইটদের ভূমিকা ও ঐতিহাসিক আবিষ্কার
গজোয়া হেভেনের মানুষরা কেবল ইতিহাসের সাক্ষী নন; তারা নিজেরাই ইতিহাসের অংশ। ইনুইটদের মৌখিক ঐতিহ্য ও স্থানীয় জ্ঞান দিয়েই আবিষ্কৃত হয়েছে স্যার জন ফ্রাঙ্কলিনের বিখ্যাত অভিযানের হারিয়ে যাওয়া দুটি জাহাজ—‘ইরেবাস’ ও ‘টেরর’।
বহু দশক ব্যর্থ অনুসন্ধানের পর ইনুইটদের পরামর্শে ২০১৪ সালে পাওয়া যায় ‘ইরেবাস’। দুই বছর পর আরেক স্থানীয় জেলে, স্যামি কগভিক, তার পুরোনো স্মৃতির সূত্র ধরে ‘টেরর’-এর অবস্থান জানিয়ে দেন। পরদিনই তা পাওয়া যায়, সমুদ্রের মাত্র ৪০ ফুট গভীরে।
গজোয়া হেভেনের ইতিহাসরক্ষক জোয়ান হুম্মাহুক’-এর উত্তরসূরিরাই এ রহস্য উন্মোচনে বড় ভূমিকা রাখেন।

গলতে থাকা বরফ, বদলে যাওয়া জীবন
গত কয়েক দশকে গজোয়া হেভেনের চারপাশের বরফের স্তর পাতলা হয়ে এসেছে। এখন বছরে তিন থেকে চার মাস জলপথ বরফমুক্ত থাকে—যা আগে ছিল অর্ধেক সময়ের কম। এর ফলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল সহজ হচ্ছে।
তবে জলবায়ুর পরিবর্তনে স্থানীয় জীববৈচিত্র্যও বদলে যাচ্ছে—দক্ষিণের গ্রিজলি ভাল্লুক এখন নিয়মিত আসে মেরুভল্লুকের এলাকায়, আর টুন্ড্রাজুড়ে সবুজ ঝোপঝাড় বেড়ে উঠছে। মেয়র কুকশুন মজা করে বলেন, “আরও ৫০ বছর পর হয়তো এখানে পামগাছও দেখা যাবে!”
ঐতিহাসিক স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক সংযোগ
ফ্রাঙ্কলিন অভিযানের গল্প ইনুইটদের লোকগাঁথায় এখনো বেঁচে আছে। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, তাদের পূর্বপুরুষরা ক্ষুধার্ত অভিযাত্রীদের কাঁচা মাছ ও সীলের মাংস দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ১৮৪৮ সালে দলটি জাহাজ ছেড়ে হাঁটতে শুরু করেছিল—কিন্তু সবাই মারা যায় ঠান্ডা, ক্ষুধা ও রোগে।
এই ইতিহাস এখন উপনিবেশিক অহংকারের করুণ শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় ইনুইটদের এই কাহিনি বলা ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু এখন তা জাতীয় গর্বের উৎস।

নতুন সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম
গজোয়া হেভেনের আইনসভা সদস্য টনি আকোয়াক বলেন, “ট্রাম্পের বক্তব্য আমাদের আরও সতর্ক করেছে। নুনাভাটে অবকাঠামো উন্নয়ন এখন অপরিহার্য—বড় বিমানবন্দর, গভীর বন্দর, শক্তিশালী নৌঘাঁটি ছাড়া আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারব না।”
আজও এ অঞ্চলে নেই পাকা রাস্তা, ঘাট বা পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। কিন্তু ইনুইটদের দৃঢ় অবস্থানই কানাডার দাবিকে জীবিত রাখছে—আর্কটিক এখন শুধু বরফের নয়, ইতিহাস, ভবিষ্যৎ ও জাতির মর্যাদারও প্রতীক।
# আর্কটিক, #কানাডা, #যুক্তরাষ্ট্র,# নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ, #জলবায়ু পরিবর্তন, #রাশিয়া,# ইনুইট, #আন্তর্জাতিক রাজনীতি,# ট্রাম্প,# আর্কটিক সার্বভৌমত্ব
সারাক্ষণ রিপোর্ট 
















