উত্তরাঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এই অ-ইউরিয়া সারের সরবরাহে কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কৃষকদের দাবি, অনুমোদিত ডিলারদের কাছে সার নেই বলা হলেও খুচরা বাজারে বাড়তি দামে সহজেই মিলছে; ফলে জমি প্রস্তুত ও বপন বিলম্বিত হচ্ছে এবং ফলন কমার আশঙ্কা বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, গুদামে পর্যাপ্ত মজুত আছে; কিছু অসাধু মহল লাভের আশায় বাজারে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের অবস্থা
উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা—রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী—জুড়ে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের কৃত্রিম সংকট নিয়ে কৃষকদের ভোগান্তি বাড়ছে। অনেকেই বাড়তি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন বা জমি প্রস্তুত ও বপন বিলম্বিত করছেন, ফলে ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কৃষি বিভাগ পরিস্থিতিকে কৃত্রিম বললেও কৃষকদের অভিযোগ, অফিসিয়াল ডিলারদের মাধ্যমে সার মিলছে না; মৌসুমি চাহিদার সুযোগে খুচরা বিক্রেতারা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন।
কর্তৃপক্ষের দাবি
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) জানিয়েছে, গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে এবং প্রকৃত কোনো ঘাটতি নেই। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, কিছু অসাধু ডিলার অধিক মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। রংপুর অঞ্চলের কর্মকর্তারা বলেন, কোনো জেলায় বাস্তব সংকট নেই; বাজার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে বলে তারা আশা করেন।

উত্তরাঞ্চলে জমি প্রস্তুতে বাধা
আলু ও ভুট্টা রোপণের মৌসুম সামনে থাকায় অনেক কৃষক সময়মতো জমি প্রস্তুত করতে পারছেন না। লালমনিরহাটের কারনপুর গ্রামের কৃষক আব্দার হোসেন জানান, ডিলারদের কাছে সার নেই বলা হলেও খুচরা দোকানে পর্যাপ্ত সার আছে—তবে কেজিপ্রতি ৮–১০ টাকা বেশি দাম নিতে হচ্ছে। পাটগ্রামের বাউড়ার কৃষক আবু তালেব বলেন, অ-ইউরিয়া সার ছাড়া জমি প্রস্তুত করা যায় না; এখনই সারের প্রয়োজন, নভেম্বরে চাহিদা আরও বাড়বে—সময়মতো না পেলে বড় ক্ষতি হবে। রংপুরের গঙ্গাচড়ার কৃষক সুজন মিয়া জানান, বাড়তি দাম দিতেও রাজি, তবু সার পাওয়া যাচ্ছে না। কৌনিয়ার কৃষক জয়নাল আবেদিনের অভিযোগ, ডিলারদের কাছ থেকে সার মেলে না, অথচ খুচরা দোকানে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে—সবকিছুই নিয়মের বাইরে চলছে।
নির্ধারিত দাম ও বরাদ্দ
বিএডিসি লালমনিরহাট গুদামের সহকারী পরিচালক একরামুল হক জানান, জেলায় ১৪৪ জন অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে সরকারি নির্ধারিত দামে সার বিক্রি হচ্ছে। সরকারের নির্ধারিত হিসেবে ডিলারদের কাছে টিএসপি কেজি ২৫ টাকা, ডিএপি ১৯ টাকা এবং এমওপি ১৮ টাকায় সরবরাহ করা হয়; ডিলাররা কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ২ টাকা মুনাফা রাখতে পারেন। তার ভাষ্য, সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী গুদামে পর্যাপ্ত মজুত আছে; তবে মোট চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ প্রায় ২৫ শতাংশ কম।
কৃষি সম্প্রসারণের অবস্থান
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিএডিসি গুদামে পর্যাপ্ত সার আছে। তবুও কিছু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার আশায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। এদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।

ডিলার সংগঠনের মত
কিছু ডিলার অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়নের ডিলার আবু তাহের বলেন, সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তা-ই নির্ধারিত দামে বিক্রি করা হয়; কেউ বেশি দামে বিক্রি করেন না। খুচরা বাজারে বাড়তি দামে সার যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতারা কোথা থেকে সার সংগ্রহ করছেন, তা তাদের জানা নেই। লালমনিরহাট জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হাকিমের মতে, সংকটের মূল কারণ বরাদ্দ কম থাকা—বিশেষ করে চরাঞ্চলে যেখানে উৎপাদন বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের সার নীতিমালা অনুযায়ী চাহিদাভিত্তিক সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে সংকট হতো না; তবুও কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রংপুর জেলা সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেমও মনে করেন, ঘাটতির পেছনে প্রধান কারণ বরাদ্দ কমে যাওয়া; তবে তিনি আশা করেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে।
তদারকি ও আইনপ্রয়োগ
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, অবৈধ সার বিক্রি ঠেকাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক উপজেলায় ইতোমধ্যে অভিযান চালানো হয়েছে এবং কয়েকজন ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে। তার দাবি, কোথাও সার সংকট নেই।
#সারসংকট #উত্তরবঙ্গ #কৃষি #বিএডিসি #টিএসপি #ডিএপি #এমওপি #ডিলার #খুচরাবাজার #ফসলউৎপাদন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















