কৃষিজীবনের টানাপোড়েন: অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত মৌসুম
মধ্যপ্রদেশের কাদওয়ালি বজুর্গ গ্রামের চাষি অঞ্জাবাই হাঁটছিলেন গোড়ালি-সমান কাদায়, মরিয়া হয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন তাঁর সয়াবিন গাছগুলো—যেগুলো টানা অস্বাভাবিক বর্ষণে পচে গেছে।
অর্ধ হেক্টর জমি থেকে তিনি মাত্র ৮০ কেজি ফসল তুলতে পেরেছেন, যেখানে খরচ সামলাতে দরকার ছিল অন্তত ৫০০ কেজি। ফলে দিনমজুরি করে অন্য কৃষকের জমিতে কাজ করেই এখন কোনোভাবে টিকে আছেন; মজুরি দিনে ২৫০ রুপি, মাত্র।
ঋণ আর আত্মহত্যার ভয়াবহ বাস্তবতা
মধ্যপ্রদেশে কৃষকদের ঋণের ভার এখন নিত্যচিত্র। অক্টোবরে একই রাজ্যের এক কৃষক আত্মহত্যা করেন হতাশাজনক ফসল ফলনের পর, পরের সপ্তাহে আরও দুজন একই পথ বেছে নেন। পরিবারগুলো বলছে, ঋণের চাপ ও ফসলহানিই এই মৃত্যুর মূল কারণ।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হলুদ মোজাইক ভাইরাস, যা রাজ্যের সয়াবিন ফসল আরও ধ্বংস করছে।
দাম পড়ে যাচ্ছে, নতুন আতঙ্কে কৃষকরা
সরকারি সমর্থিত ইন্দোর মান্ডিতে আগস্টের পর থেকে সয়াবিনের দাম ১০ শতাংশ কমেছে, যদিও ফলন ভয়াবহভাবে কম। কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মেনে আমদানি শুল্ক কমায় বা জিএম সয়াবিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তাহলে দাম আরও ধসে পড়বে।
“যদি বড় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন, আমরাও টিকতে পারব না,” বলেন ৬০ বছর বয়সী অঞ্জাবাই।
মোদির দ্বিধা: কৃষক না বাণিজ্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য কৃষকদের এই দুরবস্থা এক বড় রাজনৈতিক সংকট।
দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ কৃষি-নির্ভর, এবং তাদের অধিকাংশই ছোট ও ঋণগ্রস্ত কৃষক। এসব কৃষককে রক্ষা করতে সরকার ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপিত রেখেছে, যা বিদেশি প্রতিযোগিতা ঠেকায়।
কৃষকদের আন্দোলন ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী প্রভাব রাখে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর দু’দফা বড় কৃষক আন্দোলনে সরকারকে আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হতে হয়েছে। বিশেষত বিহার ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে কৃষকরাই ভোটের মূলভিত্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও রপ্তানির ধস
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য দ্বন্দ্বে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে। আগস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অধিকাংশ ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২০ দশমিক ৭ শতাংশ কমে যায়।
ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আনন্ত নাগেশ্বরন অনুমান করেছেন, এই শুল্ক বছরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধিকে ০.৫ থেকে ০.৬ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
ওয়াশিংটন চায়, ভারত যেন রাশিয়ান তেল আমদানি বন্ধ করে এবং মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য বাজার খুলে দেয়—বিশেষত সয়াবিন, ভুট্টা, গম ও দুগ্ধপণ্যের ক্ষেত্রে।
কৃষকের পক্ষে ‘দেয়াল’ হয়ে মোদি
স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লায় ভাষণে মোদি ঘোষণা দেন, “ভারতের কৃষক, পশুপালক ও জেলেরা আমাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকার। আমি তাদের স্বার্থরক্ষায় কোনো আপস করব না।”
তবে কৃষকরা এখন সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা দেখতে চান।
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সাল নাগাদ ভারতের অর্ধেক কৃষক ঋণগ্রস্ত ছিলেন; গড় ঋণ ছিল ৭৪,০০০ রুপি। এর বড় অংশই আসে বড় কৃষকদের কাছ থেকে, যারা বীজ-সার দেন ঋণের বিনিময়ে এবং ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেন।
২০২৩ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,৭৮৬।
সয়াবিন বাজারে ধস, বিকল্প খুঁজছেন কৃষকরা
মধ্যপ্রদেশ দেশের ৪২ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদন করে। গত চার বছর ধরে দাম ক্রমে কমছে, অনেক পশুখাদ্য উৎপাদক এখন সয়াবিনের বদলে ভুট্টা ব্যবহার করছে।
সরকারি ক্রয়মূল্য প্রতি ১০০ কেজিতে ৫,৩২৮ রুপি হলেও বাজারে দাম ১,৫০০ থেকে ৪,৫০০ রুপির মধ্যে ওঠানামা করছে।
ইন্দোর মান্ডিতে কৃষক রাজেশ চৌধুরীর ফসলের আর্দ্রতা ধরা পড়ে ১৬ শতাংশ—নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। “ভগবান আছেন, কিন্তু যেন অন্ধ,” বলেন তিনি; ফসল বিক্রির টাকায় আগের ঋণও শোধ হয়নি।
মার্কিন কৃষি শক্তি বনাম ভারতের সীমাবদ্ধতা
একজন ব্যবসায়ী বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রাজিল থেকে আমদানি বাড়ে, তা আমাদের ও কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর।”
চিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের দামে দেখা গেছে, মার্কিন সয়াবিন ভারতের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ সস্তা—উচ্চ ফলনশীল জিএম বীজ ও সরকারের ভর্তুকির কারণে।
সংযুক্ত কিসান মরচা নেতা শিবকুমার কাক্কা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো ছাড় দেওয়া হলে সেটা ২০২০ সালের কৃষি আইনগুলোর চেয়েও ভয়াবহ হবে।”
প্রযুক্তিজ্ঞানী তরুণ কৃষক ও রাজনীতির সুর
কংগ্রেস নেতা কেদার সিরোহি জানান, তরুণ কৃষকেরা এখন ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপে এসব বাণিজ্য আলোচনার খবর রাখছে।
বিহারে, যেখানে ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষি-নির্ভর, এই মাসের নির্বাচন মোদির কৃষি নীতির প্রতি ভোটারদের মনোভাব বোঝার বড় সুযোগ দেবে।
বিকল্প ফসল ও মার্কিন শুল্কের প্রভাব
ট্রাম্পের শুল্কে ভারতের মাখানা বা ফক্স নাটস রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশীয় বাজারে সরকারি সহায়তায় এর বিক্রি বেড়েছে। এখন দেশীয় বিমানবন্দর ও দোকানগুলোতেও মাখানা সহজলভ্য।
তবে বিহারের কৃষকদের প্রধান ফসল গম ও ভুট্টা; তাই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য চুক্তি তাদের ভাগ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে। স্থানীয় সাংবাদিক মনোজ গাইরোলা বলেন, “এখনও পর্যন্ত বিষয়টি মাঠ-পর্যায়ে আলোচনায় আসেনি, কারণ সরকার কৃষিখাতে কোনো ছাড় দেয়নি।”
ভারতের কৃষকেরা এখন এক গভীর সংকটে—একদিকে ঋণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কম দাম; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাপ।
মোদি সরকার মার্কিন চাপ সামলাতে চাইছে, কিন্তু কৃষকদের রোষ ও ভোট-রাজনীতির বাস্তবতা তাকে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
কৃষকেরা বলছেন, এখন তারা শুধু একটাই প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখছেন—“মোদির দেয়াল” যেন সত্যিই তাদের পাশে থাকে।
#ভারত #কৃষকসংকট #মোদি #ট্রাম্প #বাণিজ্যআলোচনা #সয়াবিন #মধ্যপ্রদেশ #যুক্তরাষ্ট্রভারতসম্পর্ক #এশিয়াঅর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















