বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় নারী রাজনীতিকদের ভূমিকা আবারও উপেক্ষিত হয়েছে। আন্দোলন-সংগঠনে সক্রিয় ও দীর্ঘদিনের নিবেদিত নেত্রীদের অনেকেই এবারও মনোনয়ন পাননি, যা দলটির পুরুষকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
পুরুষকেন্দ্রিক রাজনীতির পুরনো ছক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের অংশগ্রহণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিশ্রুতি ও বক্তব্য শোনা গেলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন এখনো সীমিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সেই দলই সাম্প্রতিক প্রার্থী বাছাইয়ে নারীদের প্রতি একপ্রকার উপেক্ষার মনোভাব দেখিয়েছে।
দলের একাধিক পর্যায়ের নেত্রী, যারা মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থেকে আন্দোলন-সংগঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তারা এবারও টিকিট পাননি। প্রার্থী তালিকায় নারীর সংখ্যা যে পরিমাণে কম, তা শুধু হতাশাজনক নয়, বরং এটি দলের নারী রাজনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
আন্দোলনে সক্রিয় নারীরা থেকেও বাদ
বিএনপির নারী নেত্রীদের অভিযোগ, তারা দীর্ঘ বছর ধরে মাঠে থেকেও প্রার্থী নির্বাচনে উপেক্ষিত হচ্ছেন। আন্দোলনের দিনগুলোতে গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি সত্ত্বেও যারা দলের প্রতি অনুগত ছিলেন, তাদের জায়গা দখল করেছে প্রভাবশালী পুরুষ রাজনীতিকদের নাম।

কিছু নারী নেত্রীর ভাষায়, “দল যখন সংকটে, তখন আমরা সামনে ছিলাম। কিন্তু নির্বাচনের সময় এলেই আমরা অদৃশ্য হয়ে যাই।”
এই অবস্থাকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ‘দলীয় পুরুষতন্ত্রের প্রতিফলন’ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, বিএনপির মতো ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর ভেতরে নারীদের অংশগ্রহণকে এখনো ‘সাজসজ্জার অংশ’ হিসেবেই দেখা হয়, কার্যকর নেতৃত্ব বা নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব নয়।
সংখ্যার হিসাবই বলে দেয় বাস্তবতা
দলের ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় নারী প্রার্থীর সংখ্যা মোট প্রার্থীর পাঁচ শতাংশেরও কম। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থী বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বিএনপি এই বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতি দেখাতে পারেনি।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, টিকিট বণ্টনে এখনো অগ্রাধিকার দেওয়া হয় প্রভাব, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সম্পর্কের ওপর—যে জায়গাগুলোতে নারীরা এখনো দুর্বল।
নারীবান্ধব ভাবমূর্তি বনাম বাস্তবতা
বেগম খালেদা জিয়া ও তার উত্তরসূরি হিসেবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি নিজেদের ‘নারীবান্ধব দল’ হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত সীমিত।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ কমে এসেছে গত এক দশকে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের নারী রাজনীতিকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন এবং অনেকেই বিকল্প রাজনৈতিক বা সামাজিক প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন।
পরিবর্তনের দাবি
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বিএনপি সত্যিই গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়, তবে নারী নেতৃত্বকে দৃশ্যমানভাবে জায়গা দিতে হবে। প্রার্থী বাছাইয়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো শুধু ন্যায্যতার প্রশ্ন নয়, বরং এটি দলের আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তির জন্যও অপরিহার্য।
একজন সিনিয়র বিশ্লেষকের ভাষায়, “নারীদের বাদ দিয়ে কোনো দল দীর্ঘমেয়াদে জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে পারে না। নারীরা শুধু ভোটার নয়, তারা নেতৃত্বের যোগ্যতাও প্রমাণ করেছেন বারবার।”
বিএনপির নারী রাজনীতিকদের প্রতি এই অবহেলা শুধু প্রার্থিতা বণ্টনের বিষয় নয়; এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন, যেখানে নারীদের এখনো নেতৃত্ব নয়, সহযোগী ভূমিকা প্রত্যাশা করা হয়।
তবে সময় এসেছে এই মানসিকতার পরিবর্তনের। নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো মানে শুধু নীতিগত প্রতিশ্রুতি নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশেরও অপরিহার্য ধাপ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















