উপন্যাস থেকে মঞ্চে: এক ঝলমলে অভিযোজন
অ্যালান হলিংহার্স্টের বুকারজয়ী উপন্যাস দ্য লাইন অব বিউটি (২০০৪) কেবল একটি পরিবারের গল্প নয়; এটি সমগ্র এক যুগের প্রতিচ্ছবি—থ্যাচার শাসনের রাজনীতি, ধনীদের ভণ্ডামি, এবং ১৯৮০–এর দশকের সমকামী সংস্কৃতির উচ্ছ্বাস ও বেদনা। সেই বিস্তৃত ও বহুস্তরীয় উপন্যাসকে মঞ্চে রূপ দিতে চেয়েছেন পরিচালক জ্যাক হোল্ডেন। তাঁর এই নতুন অভিযোজনটি যেমন ঘন ও দ্রুতগামী, তেমনি কিছু জায়গায় মূল উপন্যাসের গভীরতার ঘাটতিও স্পষ্ট।
ফেডেন পরিবার: ক্ষমতার কেন্দ্র ও নাটকের মূলে
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফেডেন পরিবার—যার কর্তা জেরাল্ড ফেডেন (চার্লস এডওয়ার্ডস) সদ্য নির্বাচিত এক কনজারভেটিভ এমপি। তাঁদের কেন্সিংটনের বিলাসবহুল বাড়িতে আশ্রয় নেয় মধ্যবিত্ত, লাজুক, অক্সফোর্ড–পড়ুয়া সমকামী তরুণ নিক গেস্ট (জ্যাসপার ট্যালবট)। নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই সে এক “অতিথি”—পরিবারের ঘনিষ্ঠ অথচ অচেনা এক মানুষ।
নিক চরিত্রে ট্যালবটের অভিনয়ে মিশেছে কৌতুক, সরলতা ও ভাবুকতার সুষম সংমিশ্রণ। তাঁর একান্ত মনোলগ—যেখানে তিনি জীবনে সৌন্দর্যের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন—পুরো নাটকের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তগুলোর একটি।
সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব ও গোপন প্রেম
নাটকে নিকের জীবনে আসে দুজন প্রেমিক—শ্রমজীবী লিও (আলিস্টেয়ার নওয়াচুকু) এবং ধনাঢ্য, দ্বৈতজীবনযাপনকারী ওয়ানি (আর্তি ফ্রুশান)। ওয়ানি বাগদত্তা থাকা সত্ত্বেও নিকের সঙ্গে গোপন সম্পর্কে জড়িত। তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন, মাদক ও প্রলোভনের দৃশ্যগুলো নাটককে একইসঙ্গে বাস্তব ও বিদ্রূপাত্মক করে তোলে।
তবে হলিংহার্স্টের উপন্যাসে সম্পর্কগুলোর যে গভীরতা ও শারীরিক সত্যতা ছিল, মঞ্চরূপে তা খানিকটা সংক্ষিপ্ত মনে হয়। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রেম ও প্রতারণার আভাসে দর্শক নিকের মানসিক যাত্রা উপলব্ধি করতে পারেন।
প্রেক্ষাপট: উজ্জ্বলতার আড়ালে সমাজের কপটতা
ফেডেন পরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি থেকে লিওর সাধারণ রান্নাঘর—ডিজাইনার ক্রিস্টোফার ওরামের সেট ডিজাইন দর্শককে এক মুহূর্তে স্থানান্তরিত করে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ৮০–এর দশকের সঙ্গীত—নিউ অর্ডার, ফ্র্যাংকি গোজ টু হলিউড, দ্য কমিউনার্ডস—সময়ের আবহ তৈরি করে।
তবে এই জৌলুসের মধ্যেই উঁকি দেয় সমাজের শ্রেণিবৈষম্য, বর্ণবাদ ও গোপন সমকামী–বিদ্বেষ। জেরাল্ড ফেডেনের রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকা কেলেঙ্কারি শেষে তাঁর মুখোশ খুলে দেয়; “তুমি লোভী ছোটলোক” বলে নিককে অপমান করার সময় দর্শক প্রত্যক্ষ করে তাঁর আসল চেহারা—অসহিষ্ণু, পক্ষপাতদুষ্ট, ক্ষমতালোভী।
থ্যাচার যুগের ছায়া ও সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা
নিকের চরিত্রে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবির’ কারাওয়ে–সুলভ বর্ণনাভঙ্গি স্পষ্ট। সে যেমন অভিজাত সমাজের অংশ, তেমনি বহিরাগতও। ফেডেন পরিবার টম ও ডেইজির মতো—অন্যের জীবন ধ্বংস করেও নিজে নির্লজ্জভাবে এগিয়ে চলে।
নাটকটি মনে করিয়ে দেয়, ৮০–এর দশকের ব্রিটেনের মতো আজও ক্ষমতাসীন রাজনীতি ও সামাজিক সহনশীলতার ঘাটতি একইভাবে বিদ্যমান। এটি যেমন অতীতের প্রতিচ্ছবি, তেমনি বর্তমানের জন্যও এক সতর্কবার্তা।
জ্যাক হোল্ডেনের এই নাট্যরূপ যদিও উপন্যাসের মতো গভীর নয়, তবুও তা প্রাণবন্ত, দৃষ্টিনন্দন এবং ভাবনাজাগানিয়া। মাইকেল গ্র্যান্ডেজের পরিচালনা ও গোটা কাস্টের পারফরম্যান্স নাটকটিকে দৃঢ় গতি ও সৌন্দর্য দিয়েছে।
‘দ্য লাইন অব বিউটি’ শেষ পর্যন্ত এক যুগের প্রতিচ্ছবি—যেখানে প্রেম, রাজনীতি ও শ্রেণি–অহমিকার সংঘাত একসঙ্গে মিশে গেছে এক শ্বাসরুদ্ধকর নাট্যভাষায়।
																			
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 


















