যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থায় আটকে আছে। এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়া বা সিউল এমন এক অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং—উভয় পক্ষের প্রত্যাশা ও উদ্বেগ সমন্বয় করে আলোচনার পথ আবারও খুলে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
অচল আলোচনার প্রেক্ষাপট
ওয়াশিংটন ক্রমেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে উত্তর কোরিয়ার সম্পূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আদৌ সম্ভব কি না, আর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের উদ্যোগও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। অন্যদিকে পিয়ংইয়ংয়ের কাছে তাদের পরমাণু কর্মসূচি একেবারেই অচলনীয় বিষয়। এটি শুধু জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক নয়, বরং দেশের ভেতরে ক্ষমতা ও প্রতিরোধ কৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও মিত্রদের যৌথ সামরিক মহড়া এই অনমনীয় অবস্থান আরও কঠোর করেছে।

সিউলের মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা
এই গভীর মতপার্থক্যের মাঝেও দক্ষিণ কোরিয়া আলোচনার ভিত্তি তৈরির চেষ্টা করছে। সিউলের ধারণা, তারা এমন প্রভাব রাখে যার মাধ্যমে ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ের প্রত্যাশার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ সামরিক মহড়া নিয়ে আলোচনার দরজা খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি উত্তর কোরিয়ার হুমকিবোধ কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
সাম্প্রতিক জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্রে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিশ্চিত করার সরাসরি অঙ্গীকার আর রাখেনি। এই পরিবর্তন পিয়ংইয়ংয়ের কাছে এমন বার্তা দিচ্ছে যে, ভবিষ্যৎ আলোচনায় নিরস্ত্রীকরণই চূড়ান্ত লক্ষ্য নাও হতে পারে। এতে পরমাণু ঝুঁকি হ্রাসের মতো তুলনামূলক নরম লক্ষ্য নির্ধারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সামরিক মহড়া ও উত্তেজনা
উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়াকে আগ্রাসনের মহড়া হিসেবে দেখে। ২০১৯ সালে বড় আকারের মহড়ার বদলে ছোট পরিসরের অনুশীলনের ঘোষণা দেওয়া হলেও ২০২২ সালে তা আবার বড় আকারে ফিরে আসে। সিউল এখন চাইছে এই মহড়ার সময়, পরিসর ও উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করতে, যাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সামরিক শক্তির চেয়ে অগ্রাধিকার পায়।
ওয়াশিংটনের দ্ব্যর্থক বার্তা
যুক্তরাষ্ট্র একদিকে কৌশলপত্রে নিরস্ত্রীকরণকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় সেটিকে এখনও নীতির অংশ হিসেবে তুলে ধরছে। এই দ্বৈত বার্তা পিয়ংইয়ংয়ের কাছে বিভ্রান্তিকর এবং অতীতের অভিজ্ঞতায় এটি উত্তেজনা বাড়িয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আর নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার সংঘর্ষ আগেও আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করেছে।

নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পথে সিউল
এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়া নিষেধাজ্ঞা শিথিলের দিকেও এগোচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘোষণায় সিউল জানিয়েছে, তারা উত্তর কোরিয়ার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিলের উদ্যোগ নেবে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে যৌথ কর্মপর্যায়ের বৈঠক শুরু করতে চায়, যাতে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ তৈরি হয়।
বাস্তববাদী লক্ষ্য ও সম্ভাব্য অগ্রগতি
উত্তর কোরিয়া স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা পরমাণু অস্ত্র ছাড়বে না। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে দক্ষিণ কোরিয়া এখন সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের বদলে অস্ত্র উন্নয়ন স্থগিত বা পরমাণু ঝুঁকি কমানোর মতো মধ্যবর্তী লক্ষ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন অবস্থান ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে বলে ইঙ্গিত মিলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পিয়ংইয়ংয়ের আস্থা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। সব মিলিয়ে, অচল আলোচনায় প্রাণ ফেরাতে সিউলের কৌশল ও প্রভাবই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হয়ে উঠছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















