ভারতের আদানি গোষ্ঠী দাবি করেছে যে বাংলাদেশের কাছে রফতানি করা বিদ্যুতের দাম নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে দুই পক্ষই সালিশি প্রক্রিয়ায় যেতে সম্মত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সরকার জানিয়েছে, আলোচনা হলেও এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিবিসি বাংলাকে পাঠানো এক বিবৃতিতে আদানি গোষ্ঠী বলছে, চুক্তি অনুযায়ী যেকোনো মতানৈক্য সমাধানে আন্তর্জাতিক সালিশি প্রক্রিয়াই একমাত্র পথ।
তারা এও জানিয়েছে যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যে দাম দিতে রাজি হয়েছে, সেই অনুযায়ী নিয়মিত অর্থ তারা পেয়ে যাচ্ছে।
তবে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে তারা বিদ্যুৎও দিয়ে যাবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিবিসিকে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা আলোচনা করছেন, তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
তবে সালিশি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার কথা আদানি গোষ্ঠী ঘোষণা করার ঠিক আগেই বাংলাদেশের সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল যে দেশটির বিদ্যুৎখাতে আগের সরকারের আমলে যে-সব চুক্তি হয়েছিল, তাতে অনেক দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ঘোষণা করেছিলেন যে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে তারা চুক্তি বাতিলের পথেও হাঁটতে পারেন।
তবে আন্তর্জাতিক চুক্তি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পেয়ে বাতিল করে দেওয়া কঠিন কাজ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় অবস্থিত ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি করে আদানি গোষ্ঠী। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোটাই বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
এছাড়া ভারত সরকারিভাবেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি করে থাকে।
গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের সঙ্গে বিদ্যুতের দাম নিয়ে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে মতানৈক্য চলছে।
এবছরের গোড়ায় বিদ্যুতের দাম হিসেবে বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রায় দু-শো কোটি ডলার বকেয়া ছিল বলে আদানি গোষ্ঠী গত সপ্তাহে জানিয়েছিল। কিন্তু এখন বকেয়ার পরিমাণ কমে এসে মাত্র ১৫ দিনের পাওনা বাকি আছে বলে জানিয়েছে শিল্প গোষ্ঠীটি।

কেন সালিশিতে যাচ্ছে দুই পক্ষ?
আদানি গোষ্ঠীর এক মুখপাত্র লিখিত বিবৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “যেহেতু এটা একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি, তাই চুক্তির কোনো বিষয় নিয়ে মতানৈক্য হলে একমাত্র আন্তর্জাতিক সালিশি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তার সমাধান করার কথা রয়েছে ওই চুক্তিতে”।
“বর্তমানে কিছু খরচ যেভাবে হিসাব করা এবং বিলিং করা হচ্ছে, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। তাই দুই পক্ষই বিতর্ক সমাধানের পদ্ধতি ব্যবহার করতে রাজি হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই দ্রুত, মসৃণভাবে এমন একটা সমাধান বেরবে, যাতে দুই পক্ষই লাভবান হয়,” বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন আদানি গোষ্ঠীর এক মুখপাত্র।
তারা বলেছে যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিটিকে তারা মর্যাদা দেবে এবং বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যাবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিসমূহ পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশে যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল, তারা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের হাতে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিয়েছেন রোববার।
ওই কমিটির প্রধান, হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে তারা ব্যাপক দুর্নীতি, যোগসাজশ, জালিয়াতি পেয়েছেন।
ওই কমিটির একজন সদস্যের নাম উল্লেখ না করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলিতে আইনি জটিলতা থাকে এবং একতরফা তা বাতিল করে দিলে বড়সড় ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।

যা বলছে বাংলাদেশ সরকার
আদানি গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিবিসিকে বলেছেন যে এখনো আলোচনা চলছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তিনি এর আগে বলেছিলেন যে “সেই পর্বটা মিটে গেলে আন্তর্জাতিক সালিশিতে যদি যেতে হয়, তাহলে সেই দিকেই এগোব আমরা”।
গত ডিসেম্বর মাসেই সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিল, গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে কর-ছাড় পায় আদানি গোষ্ঠী, তার সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স গত বছর ডিসেম্বর মাসে এক ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে আদানি গোষ্ঠীর গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিই হয়েছিল বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য। এর জন্য কয়লা আমদানি করে ওই গোষ্ঠী।
বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরে, ২০১৯ সালে গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়, যার ফলে আয়কর সহ নানা কর-ছাড় পেতে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রদেয় কর-কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন হলে তা বাংলাদেশেকে দ্রুত জানানো এবং কর-ছাড় থেকে প্রাপ্ত সুবিধা বাংলাদেশকেও দেওয়ার কথা, এমনটাই জানিয়েছিল রয়টার্স।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও বলে আসছে, বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে তাদের ট্যাক্স বেনেফিট দেওয়া হয়নি।
তবে আদানি বলছে, এই ছাড় তারা পায় না।
ফলে পার ইউনিট বিদ্যুতের দাম নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে।

সিঙ্গাপুরে হবে সালিশি
বিদ্যুৎ রফতানির চুক্তিতে উল্লেখ করা ছিল যে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে দুই পক্ষের মধ্যে সালিশি হবে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক বিতর্ক দেখা দিলে এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই তা মেটানো হয়ে থাকে।
কলকাতার শিল্প-বাণিজ্য বিশ্লেষক প্রতীম রঞ্জন বসু বলছিলেন, “আদানির সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে দুর্নীতি হয়েছিল কি না, সেটা তাদের দেশের আইন-আদালত বুঝবে। কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যে কোনো মতানৈক্য মেটানোর সুযোগ শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরের আন্তার্জাতিক সালিশি আদালতের মাধ্যমেই রয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনও উপায় নেই”।
“যদি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মনে করে যে চুক্তি সই করার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়েছিল, সেটার প্রমাণও ওই সিঙ্গাপুরের সালিশি কেন্দ্রতেই দিতে হবে। তা না করে যদি অন্য কোনো পদ্ধতির কথা তোলা হয়, সেটা আন্তর্জাতিক চুক্তির খেলাপ হবে,” বলছিলেন মি. বসু।
তিনি বলছিলেন, এই পদ্ধতিতে দুই পক্ষই নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী বেছে নেবে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে। মধ্যস্থতা ব্যর্থ হয়ে গেলে আরবিট্রেশান নোটিশ পাঠিয়ে সালিশি প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এরপরে নিরপেক্ষ ট্রাইবুনাল প্রমাণ খতিয়ে দেখবে আর চলবে দীর্ঘ শুনানি প্রক্রিয়া। যে রায় দেবে ট্রাইবুনাল, তা মেনে নিতে দুই পক্ষই আইনত বাধ্য থাকবে।
‘নিউ ইয়র্ক কনভেনশন, ১৯৫৯’ নামে যে আন্তর্জাতিক সনদ আছে, তা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক। বিশ্বের ১৬০টি দেশ এই ব্যবস্থাপনাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















