ঝড়ের পর বালুর নিচে লুকিয়ে থাকা অতীত
আলাস্কার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত মাছধরা গ্রাম কুইনহাগাক। গত মাসে টাইফুন হালং আঘাত হানার পর, এখানকার বাসিন্দা জিমি জোন্স সকালে সমুদ্রতটে ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ করছিলেন। হঠাৎ এক লগ তুলতে গিয়ে তিনি দেখেন বালুর নিচে দেখা যাচ্ছিল এক মুখ—এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভাবেন, হয়তো কোনো মৃতদেহ। কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝা গেল, এটি কাঠের তৈরি একটি মুখোশ, যার ওপর ক্ষীণ রঙের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।
এই টাইফুন, যা অন্তত একজনের প্রাণ কেড়ে নেয় এবং শত শত মানুষকে ঘরছাড়া করে, তিন মাইল দক্ষিণের প্রাচীন প্রত্নস্থল নুনাল্লেক থেকে হাজারো নিদর্শন তুলে এনে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। কিছু নিদর্শনের বয়স প্রায় ৬০০ বছর—যেগুলো ছিল বর্তমান ইউপিক জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সম্পদ।
তটভাঙনে ধ্বংস প্রত্নস্থল, উদ্ধার অভিযানে গ্রামবাসী
এক রাতেই ঝড় প্রায় ৬০ ফুট উপকূল ভেঙে দেয়, ধ্বংস করে দেয় খননকাজ। পরদিন থেকেই কুইনহাগাকের বাসিন্দারা ছুটে যান সমুদ্রতটে, ভেসে আসা নিদর্শন উদ্ধার করতে।
আলাস্কার পশ্চিম উপকূলে শত শত এমন গ্রাম্য প্রত্নস্থল রয়েছে, যেখানে জমাটবাঁধা মাটি শতাব্দীর পর শতাব্দী নিদর্শন সংরক্ষণ করে রেখেছে। কিন্তু খননকাজ খুবই বিরল। স্থানীয় ইউপিক প্রবীণদের অনেকেই শুরুতে এই স্থলটির খননে আপত্তি জানান—কারণ এটি পবিত্র স্থান, যেখানে রয়েছে মানবদেহাবশেষ।

গ্রামের কর্পোরেশন ‘কানির্তুক’-এর প্রধান নির্বাহী ও জিমি জোন্সের পিতা ওয়ারেন জোন্স বলেন: “এই নিদর্শনগুলো আমাদের কাহিনি বলার অপেক্ষায় ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানতে হবে আমরা কোথা থেকে এসেছি। যদি আমরা এখন কাজ না করি, এগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি: গলে যাচ্ছে ইতিহাস
উত্তর মেরুর তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে, ফলে মাটির নিচের বরফ গলছে এবং তটভূমি ক্ষয় হচ্ছে। একসময় যা শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষত থাকত, এখন তা ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, প্রাণী ও মানুষের কঙ্কাল এতটাই নরম হয়ে গেছে যে তারা সেটিকে ‘বাটার বোন’ নামে ডাকেন।
আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ুবিশেষজ্ঞ রিক থোমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই টাইফুন হালংয়ের মতো দুর্যোগ এখন আর্কটিক পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। ২০২২ সালের আগে এমন ঘটনা মাত্র একবার নথিভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরকম তিনটি ঝড় আঘাত হেনেছে।
নুনাল্লেক খনন অভিযান: ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম
২০০৯ সালে ওয়ারেন জোন্স যুক্তরাজ্যের অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক রিচার্ড নেখটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর শুরু হয় নুনাল্লেক খনন প্রকল্প, যা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউপিক নিদর্শন সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
প্রায় দুই লাখ নিদর্শন এখন সংরক্ষিত রয়েছে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে, যা একাধারে জাদুঘর ও গবেষণাগার। কাঠের বাটি, মুখোশ, পুতুল, রান্নার চামচের মতো অনেক নিদর্শন অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে, আবার অনেকের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে যেমন—কায়াকের দাঁড়, তীরের অগ্রভাগ, শিশুদের সীলচর্মের জুতার তলা ইত্যাদি।
সব নিদর্শন প্রথমে বিশেষ সংরক্ষণ তরলে ভিজিয়ে শুকানো হয়, এরপর তা জাদুঘরের বাক্স ও ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখা হয়।

স্থানীয় সম্পৃক্ততা ও গর্ব
কুইনহাগাকের প্রবীণ গ্রেস হিল বলেন, “আগে আমাদের অনেক নিদর্শন অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হতো, কারণ এখানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। এবার আমরা নিজেরাই সবকিছু করছি—এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।”
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ডোরা স্ট্রাঙ্ক বর্তমানে জাদুঘরটি পরিচালনা করেন স্বেচ্ছাশ্রমে। তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা যখন প্রথম নিদর্শনগুলো দেখে, তাদের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। আমি বলি, ‘এসব তোমাদের পূর্বপুরুষরা তৈরি করেছে।’”
অনেক নিদর্শন তাদের কাছে পরিচিত মনে হয়—যেমন কাঠের পুতুল বা ইউপিক নারীদের ঐতিহ্যবাহী চাকু ‘উলুআক’-এর প্রাচীন সংস্করণ।
অতীতের গল্প জীবন্ত হয়ে ওঠা
খননকার্যে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের প্রমাণও পাওয়া গেছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৌখিক ইতিহাসে প্রচলিত ছিল। প্রবীণ জন স্মিথের বর্ণনা অনুযায়ী, এসব নিদর্শন সেই যুদ্ধের সত্যতা প্রমাণ করছে। তিনি নিজেই প্রত্নবস্তুগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করেছেন।
রিচার্ড নেখটের অনুমান, টাইফুনের পর অন্তত এক হাজার নিদর্শন উদ্ধার হয়েছে, আর প্রায় ১০ হাজার এখনও বালুর নিচে রয়ে গেছে।
একই সমুদ্র যে উপকূল গ্রাস করছে, সেই সমুদ্রই উন্মোচন করছে আবার নতুন আবিষ্কার। নুনাল্লেকের কাছেই বরফগলা মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে প্রাচীন এক কাঠের বাড়ির অবশিষ্টাংশ—সম্ভবত নুনাল্লেকের চেয়েও পুরোনো।

ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা
কুইনহাগাক টাইফুন হালংয়ের ভয়াবহতা থেকে কিছুটা রক্ষা পেলেও প্রতিবেশী গ্রামগুলো, যেমন কিপনুক ও কুইগিলিংগক, ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েকটি ঘর প্লাবিত হয়, এবং ঢেউ পৌঁছায় জ্বালানি ট্যাংক ও নর্দমার প্রান্তে।
গ্রেস হিল বলেন, “এই ঝড় ছিল এক সতর্কবার্তা। এখন আমরা চাই গ্রামটিকে উঁচু স্থানে স্থানান্তর করা হোক। আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য—যতটুকু সম্ভব আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















