মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘আট মাসে আটটি যুদ্ধ শেষ করার’ সাহসী দাবি করে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তখন চীনের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই নজরের বাইরে থেকে গেছে—বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে অনুপ্রবেশ মোকাবিলা ও কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্ত বিরোধ নিরসনে তাদের ভূমিকা।
যুক্তরাষ্ট্রের নাটকীয় মধ্যস্থতার বিপরীতে চীনের সংযত অবস্থান
আমেরিকার মতো জোরালো ও নাটকীয় শান্তি প্রতিষ্ঠার কৌশলের বদলে চীন বেছে নিয়েছে এক সংযত, হিসেবি ও প্রতিক্রিয়ামূলক কূটনৈতিক অবস্থান। মিয়ানমারের সীমান্ত অনুপ্রবেশের ঘটনায় চীন সতর্কভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্ত বিরোধ সমাধানে আসিয়ানের নেতৃত্বকে সমর্থন দিয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একাধিকবার চীনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ২০০৯ সালের আগস্টে একটি গোলা চীনের ইউনান প্রদেশে পড়ে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি গোলা পড়লেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ২০১৫ সালের মার্চে মিয়ানমারের এক যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া বোমায় পাঁচ চীনা নাগরিক নিহত ও আটজন আহত হন—যা ছিল সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা।
চীনের শান্ত কিন্তু দৃঢ় প্রতিক্রিয়া
২০০৯ ও ২০১৩ সালের ঘটনায় বেইজিং উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কঠোর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংযত থাকতে, আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাতে এবং সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানায়।

তবে ২০১৫ সালের ঘটনায় চীন তুলনামূলক কঠোর অবস্থান নেয়। দ্রুত যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে সীমান্তে টহল জোরদার করে এবং আকাশসীমা সুরক্ষাও বাড়ায়। সে সময় চীনের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের উপ-চেয়ারম্যান ফান চাংলং মিয়ানমারকে সতর্ক করে বলেন, ঘটনাটির গুরুত্ব স্বীকার করতে হবে, অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং চীনের কাছে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।
অবশেষে পরিস্থিতি শান্ত হয় যখন মিয়ানমারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উন্না মাউং লুইন ২০১৫ সালের এপ্রিলে বেইজিং সফর করে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান এবং ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আউং থান হ্তু, যিনি তখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিশেষ কার্যক্রম ব্যুরোর প্রধান ছিলেন।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে চীনের মধ্যস্থতা
চীন সীমান্ত অনুপ্রবেশকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে দেখেনি; বরং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছে। বেইজিংয়ের মতে, এসব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য। তাই চীন বারবার মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীন ইউনানের রুইলি সীমান্ত শহরে মিয়ানমার সরকার ও কাচিন স্বাধীনতা সেনাদের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করে। এতে চীনের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং ইউনান প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধি অংশ নেন।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরও চীন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা চালিয়ে যায়। বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ‘থ্রি-ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’—যার মধ্যে ছিল মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, টা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মি—যখন যৌথভাবে সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন চীনের মধ্যস্থতায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়।
কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্ত সংঘাত ও চীনের ভূমিকা
গত জুলাইয়ে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলে চীন দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানায়।
চীন জোর দিয়ে জানায় যে তারা কোনো পক্ষের প্রতিই পক্ষপাত করবে না। যদিও কম্বোডিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, তথাপি জানা যায় যে ফনম পেন থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে চীনা অস্ত্র—যেমন রকেট লঞ্চার, কামানের গোলা ও অন্যান্য গোলাবারুদ—ব্যবহার করেছে।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির এক প্রতিনিধি থাইল্যান্ডকে আশ্বস্ত করেন যে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে চীন কম্বোডিয়াকে কোনো সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেনি; তাদের হাতে থাকা অস্ত্র পুরনো সহযোগিতার ফলাফল।
আঞ্চলিক ভারসাম্যের কৌশল ও সংঘাতের ঝুঁকি
এই সীমান্ত সংঘাত এখন এক সম্ভাব্য প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, যেখানে থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং মার্কিন তৈরি এফ–১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। সংঘাত তীব্র হলে চীন হয়তো কম্বোডিয়াকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য হবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডে নিজের উপস্থিতি জোরদার করতে পারে—যা বেইজিং কোনোভাবেই চায় না।
তাই চীন আসিয়ানের নেতৃত্বকে সমর্থন জানায়। মালয়েশিয়া, আসিয়ানের চেয়ার দেশ হিসেবে, জুলাইয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন করে—যা চীনের মতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
চীন আরও জানিয়েছে যে প্রয়োজনে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের আয়োজন করবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মাইন অপসারণসহ সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
শান্তি প্রক্রিয়ায় চীনের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ
জুলাইয়ে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে চীনা ও মার্কিন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন—এটি চীনের জন্য একটি কূটনৈতিক সাফল্য ছিল, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমানভাবে আলোচনার টেবিলে ছিল। তবে অক্টোবরের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় বেইজিং অনুপস্থিত ছিল।
চীনের মতে, সীমান্ত বিরোধের সমাধানের প্রধান দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশগুলোরই। পাশাপাশি, চীন চায় না যে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ক্ষমতা হারাক, কারণ এতে দেশটি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। তাই বেইজিং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংলাপ চালিয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্তে টেকসই শান্তি নিশ্চিত করতে এখনও অনেক পথ বাকি। এই প্রেক্ষাপটে চীন দুই দেশের সম্পর্ক মজবুত রাখতে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তার শান্তিপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
লি লিয়াং ফুক 


















