লাল টুপি, নীল কোট, স্যুটকেস আর গলায় ঝোলানো পরিচয় ট্যাগ — এই পরিচিত চেহারাই প্যাডিংটন বিয়ারকে বিশ্বের অন্যতম প্রিয় চরিত্রে পরিণত করেছে। তিনটি হলিউড ছবির নায়ক এই ভালুক এখন লন্ডনের সাভয় থিয়েটারে নতুন রূপে হাজির — ব্রিটিশ মিউজিক্যাল Paddington: The Musical-এ। প্রায় সাত দশক আগে শিশু সাহিত্যিক মাইকেল বন্ডের কলমে জন্ম নেওয়া এই চরিত্রের পথচলা এখন ব্রিটিশ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শুরুর গল্প: একা একটি খেলনা থেকে বিশ্বখ্যাত ভালুক
১৯৫৬ সালের ক্রিসমাস ইভ। লন্ডনের সেলফ্রিজ ডিপার্টমেন্ট স্টোরে একা পড়ে থাকা একটি খেলনা ভালুক দেখে মাইকেল বন্ডের মনে দয়া জাগে। তিনি সেটি কিনে স্ত্রীর জন্য উপহার দেন এবং কাছের প্যাডিংটন স্টেশনের নামে নাম রাখেন “প্যাডিংটন”।
তখন বন্ড বিবিসিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করতেন। শখের বসে লিখতে শুরু করেন প্যাডিংটনের গল্প, যা মাত্র দশ দিনে শেষ হয়। প্রকাশক উইলিয়াম কলিন্স অ্যান্ড সন্স বইটি ৭৫ পাউন্ডে কিনে নেয়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত A Bear Called Paddington বই থেকেই শুরু প্যাডিংটনের বিশ্বভ্রমণ।
বন্ড প্রায় ৩০টি বই লিখেছিলেন প্যাডিংটনকে নিয়ে, যা অনূদিত হয়েছে অন্তত ৪০টি ভাষায় এবং বিক্রি হয়েছে কয়েক কোটি কপি। লেখকের ভাষায়, “প্যাডিংটন চিরকাল আশাবাদী — যতবারই হতাশ হোক না কেন, সে ফিরে আসে আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে।”
পেরু থেকে লন্ডন: এক আশ্রয়হীন ভালুকের গল্প
বইয়ের শুরুতেই দেখা যায়, মিস্টার ও মিসেস ব্রাউন রেলস্টেশনে একটি ভালুকের দেখা পান, যার গলায় লেখা — “Please look after this bear. Thank you.”
“ডার্কেস্ট পেরু” থেকে আসা প্যাডিংটনকে তারা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান, ৩২ উইন্ডসর গার্ডেনে। সেখানেই তার নতুন পরিবার: ব্রাউন দম্পতি, তাদের সন্তান জুডি ও জনাথন, গৃহকর্মী মিসেস বার্ড এবং প্রতিবেশী মি. কারি।
প্যাডিংটনের চরিত্রটি আংশিকভাবে অনুপ্রাণিত ছিল ১৯৩০-এর দশকে ইংল্যান্ডে আগত ইহুদি শরণার্থীদের কাছ থেকে — যাদের গলায় নাম লেখা ট্যাগ ঝুলত। বন্ডের ভাষায়, “প্যাডিংটন আসলে এক অর্থে শরণার্থী। শরণার্থীদের মতো একা এবং অনিশ্চিত।”
অবিচল চেহারা, অনন্ত আবেদন
বিভিন্ন চিত্রশিল্পী ও পরিচালক প্যাডিংটনকে নানা রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু তার মূল চেহারা — নীল ডাফল কোট, লাল বুট, আর টুপি — অপরিবর্তিত। প্রযোজক সোনিয়া ফ্রিডম্যানের মতে, “প্যাডিংটন আসলে সদয়তা, সহনশীলতা আর বৈচিত্র্যের প্রতীক। সেই কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে ভালোবেসে আসছে।”

ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় যাত্রা
১৯৭০-এর দশকে Paddington Bear নামে একটি টিভি সিরিজে প্রথম দেখা যায় স্টপ-মোশন অ্যানিমেশনে তৈরি প্যাডিংটনকে। প্রায় ৬০টি পর্ব প্রচারিত হয়, যার চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন বন্ড নিজেই।
পরে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে বিশেষ পর্ব হিসেবে সিরিজটি আবার ফিরে আসে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে সম্প্রচারিত হয়ে প্যাডিংটন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে।
এরপর বড় পর্দায় আসে তিনটি জনপ্রিয় ছবি — Paddington (২০১৪), Paddington 2 (২০১৭) এবং Paddington in Peru (২০২৪)। দ্বিতীয় ছবিটি দীর্ঘ সময় ধরে Rotten Tomatoes-এ ১০০% স্কোর ধরে রেখেছিল।
রানির সঙ্গে চা
২০২২ সালে রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের প্লাটিনাম জুবিলি উদযাপনে প্যাডিংটন একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে রানির সঙ্গে চা পান করেন। দৃশ্যটি ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে।
রানির মৃত্যুর পর রাজপ্রাসাদের বাইরে শোকপ্রদর্শনে বহু মানুষ ফুলের সঙ্গে প্যাডিংটনের খেলনা রেখে যান। প্রযোজক এলিজা লামলির ভাষায়, “সেই মুহূর্তে প্যাডিংটন যেন ব্রিটেনের এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল।”
লন্ডনের রাস্তায় প্যাডিংটনের উপস্থিতি
লন্ডনের প্যাডিংটন স্টেশনে তার নামে স্থায়ী মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও ২০২৪ সালে Paddington in Peru চলচ্চিত্রের প্রচারণায় যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডজুড়ে স্থাপন করা হয়েছিল আরও ২৩টি ভাস্কর্য।
নিউবেরিতে প্যাডিংটনের একটি মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনায় আদালত অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে বলে, “তাদের এই কাজ প্যাডিংটনের সদয়তা ও সহনশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত।”
ওয়েস্ট এন্ডে মঞ্চে প্যাডিংটনের প্রত্যাবর্তন
এবার প্যাডিংটন এসেছে জীবন্ত মঞ্চে। Paddington: The Musical হচ্ছে তার গল্পের প্রথম বড় ওয়েস্ট এন্ড প্রযোজনা, যার সুরকার টম ফ্লেচার, পপ ব্যান্ড ম্যাকফ্লাই-এর সদস্য।
প্রযোজক সোনিয়া ফ্রিডম্যান ও এলিজা লামলি জানিয়েছেন, এই মিউজিক্যাল তৈরিতে লেগেছে সাত বছর। কীভাবে মঞ্চে প্যাডিংটনকে দেখা যাবে, তা রহস্যই রাখা হয়েছে — কারণ “স্পয়লার প্যাডিংটনের ভালো লাগে না।”
ফ্রিডম্যান বলেন, “আমরা একরকমভাবে প্যাডিংটনের মায়ের কথা রাখছি — ‘Please look after this bear.’ সেটিই আমরা করছি। আমরা এই ভালুকটির যত্ন নিচ্ছি।”
#PaddingtonTheMusical #LondonTheatre #MichaelBond #WestEnd #BritishCulture #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























