গাজা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা: এক ফোন কলে নাটকীয় মোড়
২০২৫ সালের ৪ অক্টোবর রাতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফোন করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে — বার্তা ছিল সংক্ষিপ্ত: গাজার যুদ্ধ শেষ। কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ট্রাম্পের দূতেরা দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে এক চুক্তি সম্পন্ন করেন।
পরবর্তী সোমবার ঘোষণা দেওয়ার আগে ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দেন, নেতানিয়াহুকে এই চুক্তি মানতেই হবে। “বিবি, তুমি বিশ্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না,” ট্রাম্প বলেন টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।
নেতানিয়াহু আপত্তি তুললেও ট্রাম্প তা উপেক্ষা করেন। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর, গোলান মালভূমির সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক পুনর্গঠন — সবকিছু স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। অবশেষে, কঠোর কথোপকথনের পর নেতানিয়াহু দুই-ধাপের এক চুক্তিতে রাজি হন, যাতে যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময়, মানবিক সহায়তা এবং গাজা থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই চুক্তি সফল হলে, এটি ইসরায়েলের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে — যেখানে প্রায় ২,০০০ ইসরায়েলি ও প্রায় ৭০,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

ট্রাম্পের “ডিলমেকার” কূটনীতি: বলপ্রয়োগ ও প্রশংসার মিশ্রণ
ট্রাম্প নিজেকে দেখছেন মধ্যপ্রাচ্যের “পুনর্গঠনকারী” হিসেবে। মোট নয় মাসে তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস, সিরিয়ায় আসাদ শাসনের পতন ত্বরান্বিত করা এবং ইয়েমেনে হুথিদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা পরিচালনার মতো পদক্ষেপ নেন।
তার লক্ষ্য ছিল ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসবিদ ও সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেনের ভাষায়, “ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির সব প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিচ্ছেন।”
ট্রাম্পের মতে, এসব সাফল্যের মূলে আছে তার সামরিক শক্তি ব্যবহারের সাহস। ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা ও ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার মাধ্যমে তিনি এক ভিন্নধর্মী বাস্তবতা তৈরি করেছেন। “কেউ সাহস করেনি, আমি করেছি — এবং তাই মধ্যপ্রাচ্য এখন বদলে গেছে,” বলেন ট্রাম্প।
ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি: নতুন সংকটের আশঙ্কা
তবে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। হামাস এখনো সব ইসরায়েলি বন্দির দেহ ফেরত দেয়নি, যার জেরে ইসরায়েল রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে, হামাস যোদ্ধারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাস্তায় গুলি করেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি ইসরায়েল আবারও হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ তোলে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে পাঠান মধ্যপ্রাচ্যে।
পরবর্তী ধাপ আরও কঠিন — ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের মাত্রা নির্ধারণ, শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠন, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা স্থাপন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান শাপিরো সতর্ক করেছেন, “এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে এটি স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হতে পারে।”

ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি ও আঞ্চলিক জোট
“আমেরিকা ফার্স্ট” ধারণাটি একসময় বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতীক হলেও ট্রাম্পের হাতে তা রূপ নিয়েছে ব্যক্তিনির্ভর কূটনীতিতে। ইউরোপে রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মেনে নিয়েও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্ত করেছেন।
রিয়াদ, আবুধাবি ও দোহা এখন ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ট্রাম্প আশা করছেন বছরের শেষে সৌদি আরবও আব্রাহাম চুক্তিতে যুক্ত হবে। তিনি গাজা সফরেরও পরিকল্পনা করছেন, যেখানে পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হবে।
তার দৃষ্টিতে, এই নতুন আঞ্চলিক সংযোগ অর্থনৈতিক বিপ্লব আনবে — ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত রেললাইন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, আঞ্চলিক জ্বালানি গ্রিড, এমনকি তেল আভিভে সৌদি পর্যটক। “সবকিছু সম্ভব,” বলেন ট্রাম্প।
“আমিই মূল চাবিকাঠি” — ট্রাম্পের আত্মবিশ্বাস
ট্রাম্পের ভাষায়, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সম্মান করতে হবে। এটা প্রায় দেশের চেয়েও বড় বিষয়।”
তার এই আত্মবিশ্বাস গাজা চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে প্রতিফলিত। হামাসকে তিনি হুমকি দেন: “তোমরা সব বন্দি ফেরত দেবে — না দিলে তোমাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হবে।”
এই কঠোর অবস্থানই আরব দেশগুলোকে আলোচনায় আনতে সাহায্য করে। তুরস্ক ও কাতার হামাসকে আলোচনায় রাজি করাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। শেষ পর্যন্ত, সৌদি আরব ও জর্ডানসহ বেশ কয়েকটি দেশ ট্রাম্পের শান্তি কাঠামোর প্রতি সমর্থন জানায়।

শান্তির ভবিষ্যৎ: স্থায়ী নাকি সাময়িক?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও চুক্তির স্থায়িত্ব নির্ভর করবে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সংহতির ওপর। ফিলিস্তিনে একক নেতৃত্বের অভাব থাকায় পরিস্থিতি জটিল। ট্রাম্প নিজেও বলেন, “তাদের এখন কোনো দৃশ্যমান নেতা নেই, কারণ সবাই হয় নিহত হয়েছে বা পদে আসতে ভয় পাচ্ছে।”
তিনি মাহমুদ আব্বাসকে পছন্দ করলেও গাজার নতুন নেতৃত্ব হিসেবে মারওয়ান বারঘুতির নাম বিবেচনা করছেন — যিনি ইসরায়েলি কারাগারে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্দী।
অন্যদিকে, নেতানিয়াহু তার ডানপন্থী মন্ত্রিসভার চাপে রয়েছেন, যারা পশ্চিম তীর দখলের পক্ষে। ট্রাম্প সতর্ক করে দিয়েছেন, “ইসরায়েল যদি সেটি করে, তাহলে মার্কিন সমর্থন হারাবে।”
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও ট্রাম্পের উত্তরাধিকার
বর্তমানে ট্রাম্প গাজা ইস্যুর বাইরে তাকাচ্ছেন — তার লক্ষ্য বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ঐক্য। তিনি বিশ্বাস করেন, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে ফিলিস্তিন প্রশ্নেও অগ্রগতি আসবে। “আমাদের এখন কোনো হুমকি নেই, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এসেছে,” দাবি করেন তিনি।
যদিও বাস্তবতা জটিল, তবু ট্রাম্পের এই উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি টিকে আছে এবং সব জীবিত বন্দিকে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, “ইসরায়েলিরা বন্দিদের জন্য এত আগ্রহ দেখাবে, আমি ভাবিনি। কিন্তু আমরা তাদের ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।”
এখন প্রশ্ন, এই শান্তি কতদিন টিকবে — আর ট্রাম্প কতটা মনোযোগ ধরে রাখতে পারবেন। “যতদিন আমি থাকব, পরিস্থিতি আরও ভালো হবে,” বলেন তিনি। “তারপর কী হবে, তা আমি জানি না।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















