আধুনিক নৌশক্তির নতুন অধ্যায়
চীন তাদের সবচেয়ে বড় ও আধুনিকতম বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’-কে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি চীনের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী এবং প্রথম সম্পূর্ণ দেশীয়ভাবে নকশা ও নির্মিত, জাহাজ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বেইজিং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।
এই সপ্তাহে হাইনান প্রদেশের সানইয়া নৌঘাঁটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রণতরীটির কমিশনিং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২,০০০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা ও নৌসদস্য এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শি জিনপিং রণতরীতে উঠে ক্রুদের সঙ্গে কথা বলেন, সিস্টেম পরিদর্শন করেন এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপাল্ট সিস্টেমটি সক্রিয় করে দেখিয়েছেন।
তাইওয়ানের কাছে শক্তি প্রদর্শন
‘ফুজিয়ান’ নামটি এসেছে সেই উপকূলীয় প্রদেশ থেকে, যা তাইওয়ানের সবচেয়ে কাছের অঞ্চল। এই রণতরীতে রয়েছে অত্যাধুনিক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপাল্ট প্রযুক্তি, যা নতুন প্রজন্মের রাডার ও প্রাথমিক সতর্কীকরণ বিমান উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। চীনের পুরোনো দুটি রণতরী এই ধরনের বিমান ব্যবহার করতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চীনের বর্তমানে ৩৭০টিরও বেশি যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনসহ বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী রয়েছে। তবে বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো শীর্ষে।

২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শি জিনপিং চীনের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করে ২১শ শতকের যুদ্ধক্ষেত্র উপযোগী বাহিনীতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষত সমুদ্রপথে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম হওয়ার জন্যই এই উদ্যোগ জোরদার হয়েছে।
রণতরী ফুজিয়ানের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
বিশ্লেষকদের মতে, ফুজিয়ান শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রের জাহাজ নয়, বরং, এটি চীনের নৌকৌশল ও পরিকল্পনা উন্নয়নের একটি পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করবে।
এই নতুন রণতরীর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে চীন এখন একযোগে তিনটি রণতরী পরিচালনা করতে পারবে, যা দীর্ঘ সময় ধরে দূরবর্তী সামুদ্রিক এলাকায় অভিযান চালানো সহজ করবে।
লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IISS) সিনিয়র ফেলো নিক চাইল্ডস বলেন, ‘ফুজিয়ানের বৈশিষ্ট্যগুলো চীনকে আরও জটিল সামুদ্রিক মহড়ায় অংশ নিতে ও বিস্তৃত পরিসরে সামরিক অভিযান পরিচালনায় সক্ষম করবে।’
পুরোনো রণতরী থেকে বড় পরিবর্তন
চীনের প্রথম রণতরীটি মূলত একটি সোভিয়েত তৈরি জাহাজের পুনর্নির্মিত সংস্করণ, যা ১৯৯৮ সালে ইউক্রেন থেকে কেনা হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ২০১৯ সালে চালু হয় এবং তা মূলত প্রথমটির নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
এই দুটি পুরোনো রণতরীতে ক্যাটাপাল্ট সিস্টেম না থাকায় ‘স্কি-জাম্প’ পদ্ধতিতে বিমান উড্ডয়ন করা হয়। এতে বিমানগুলোর ওজন ও যুদ্ধ সক্ষমতা সীমিত থাকে।
অন্যদিকে, ফুজিয়ানের ক্যাটাপাল্ট সিস্টেমের মাধ্যমে এখন চীন তাদের নিজস্ব তৈরি কে-জে-৬০০ প্রাথমিক সতর্কীকরণ বিমান, নতুন জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার এবং হালনাগাদ জে-১৫ যুদ্ধবিমান পরিচালনা করতে পারবে। সিনহুয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি প্রশিক্ষণ অভিযানে এই তিন মডেলের বিমান সফলভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন চ্যালেঞ্জ
ফুজিয়ানের মাধ্যমে চীন এখন আকাশপথে প্রাথমিক সতর্কতা ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমতুল্য সক্ষমতা অর্জনের দিকে এগোচ্ছে।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুজিয়ান চীনের নৌবাহিনীর যুদ্ধক্ষমতা বহুগুণ বাড়াবে এবং এর প্রভাব দেশের আশপাশের অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও প্রসারিত হবে।
যদিও ফুজিয়ান পারমাণবিক শক্তিচালিত নয় এবং আকারে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীগুলোর তুলনায় ছোট, তবুও এটি ৮০,০০০ টনের বেশি ওজন নিয়ে প্রায় ৪০টি ফিক্সড-উইং বিমান, ও কয়েকটি হেলিকপ্টার বহন করতে সক্ষম।
তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিমিটজ’ ও ‘জেরাল্ড আর. ফোর্ড’ শ্রেণির রণতরীগুলোর তুলনায় কম সক্ষম। ফুজিয়ানে তিনটি ক্যাটাপাল্ট থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীগুলোতে চারটি থাকে। এতে চীনা রণতরীর একসঙ্গে উড্ডয়ন ও অবতরণ পরিচালনার ক্ষমতা কিছুটা সীমিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে সক্রিয় ১১টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে, যদিও আগামী বছর একটি অবসর নিতে যাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে ৯টি অ্যামফিবিয়াস আক্রমণ জাহাজ, যেগুলোতেও বিমান মোতায়েন করা যায়।

গুয়ামের মার্কিন নৌকমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল ব্রেট মিটাস বলেন, “চীনের তিনটি রণতরী আছে, কিন্তু আমাদের সংখ্যা অনেক বেশি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা বহু বছর ধরে এগুলো পরিচালনায় অভিজ্ঞ; চীন এখনো সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমানের নিরাপত্তা ও প্রাণঘাতী সক্ষমতায় রণতরী পরিচালনা করে আসছি। চীন এখনো সেই সক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।”
#চীন #ফুজিয়ান #বিমানবাহী_রণতরী #শি_জিনপিং #যুক্তরাষ্ট্র #এশিয়া_প্রশান্ত-মহাসাগর #সামরিক_আধুনিকায়ন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















