ভবনের মহিমা ও প্রভাব
ম্যানহাটনের ২৭০ পার্ক অ্যাভিনিউতে জেপি মরগান চেজের নতুন সদরদপ্তর এখন নিউইয়র্কের আকাশরেখায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ১,৩৮৮ ফুট উঁচু এই ভবনটি শুধু উচ্চতার কারণে নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
৪৭তম ও ৪৮তম স্ট্রিটের মাঝখানে একটি সম্পূর্ণ সিটি ব্লক জুড়ে নির্মিত এই টাওয়ারের নির্মাণব্যয় প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং এতে রয়েছে ২৫ লাখ বর্গফুট এলাকা। ২০১৭ সালে ‘ইস্ট মিডটাউন’ অঞ্চলে নতুন জোনিং নীতিমালা প্রণয়নের ফলে বড় আকারের ভবন নির্মাণে অনুমতি দেওয়া হয়, তবে শর্ত ছিল—জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান ও প্রশস্ত ফুটপাত রাখতে হবে। সেই নীতির সুযোগেই জেপি মরগান তাদের পুরনো ইউনিয়ন কার্বাইড ভবন ভেঙে প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেছে।
নকশার ব্যতিক্রমী শক্তি
সড়ক থেকে তাকালে ভবনটি যেন মাটি ফুঁড়ে বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে—এমন এক শক্তিশালী অনুভূতি তৈরি করে। বিশাল স্টিলের গার্ডারগুলো ফ্যানের মতো ছড়িয়ে ভবনটিকে ৮০ ফুট ওপরে তুলে ধরেছে, যেখান থেকে শুরু হয় এর খাড়া উত্থান। নিচের অংশে প্রশস্ত ফুটপাতসহ উন্মুক্ত প্লাজা তৈরি করে শহুরে জীবনের খোলামেলা এক নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ফস্টার + পার্টনার্স’-এর এই নকশায় ‘হাই-টেক’ স্থাপত্য ধারার ছাপ স্পষ্ট। স্টিল এক্সোস্কেলেটন, তির্যক বিম, ও কাঠামোগত শক্তির দৃশ্যমান প্রকাশ ভবনটিকে এক শিল্পরূপে পরিণত করেছে। স্থপতি নরম্যান ফস্টার ভবনের কাঠামোকে নগ্ন ক্রীড়াবিদের মতো এক নান্দনিক শক্তি হিসেবে উদযাপন করেছেন।

ভবনটি উপরের দিকে ধাপে ধাপে সংকুচিত হয়েছে, যা ১৯৩০-এর দশকের আর্ট ডেকো শৈলীর নিউইয়র্কের ক্লাসিক ভবনগুলোর স্মৃতি জাগায়।
লবির রাজকীয় নকশা
ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ২৯০ ফুট দীর্ঘ এক মহৎ লবি, যা পার্ক অ্যাভিনিউ থেকে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রোঞ্জে মোড়ানো V-আকৃতির বিম দুটি যেন প্রাচীন কোনো মন্দিরের স্তম্ভের মতো। মাঝখানে আমেরিকার পতাকা ওড়ানো একটি দণ্ড পুরো পরিবেশে আনুষ্ঠানিকতা ও গাম্ভীর্য যোগ করেছে।
দর্শনার্থীরা নিরাপত্তা সীমা অতিক্রম করতে না পারলেও লবির মহিমা ও জারহার্ড রিখটারের দুটি বৃহৎ চিত্রকর্ম উপভোগ করতে পারেন। এটি নিউইয়র্কের অন্যতম সুন্দর লবি হিসেবে বিবেচিত, এমনকি ঐতিহাসিক উলওয়ার্থ বিল্ডিংয়ের সঙ্গেও তুলনীয়।
কর্মপরিবেশ ও মানবিক দৃষ্টি
এই ভবন শুধু স্থাপত্যের গৌরব নয়, এটি কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রতিও যত্নবান। এখানে প্রায় ১০,০০০ কর্মী কাজ করবেন। অফিসে সরবরাহকৃত বাতাস সাধারণ ভবনের তুলনায় দ্বিগুণ, আর প্রাকৃতিক আলো ৩০ শতাংশ বেশি। বিশাল জানালা ও উচ্চ সিলিং ভবনের অভ্যন্তরে উন্মুক্ততার অনুভূতি জাগায়।
১৪ তলায় রয়েছে ট্রিপল-হাইট স্কাই লবি—এক প্রাণবন্ত সামাজিক স্থান, যেখানে সহকর্মীরা আরাম করে কথা বলতে, খাবার খেতে ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।
মানবকেন্দ্রিক স্থাপত্যের প্রতীক
নরম্যান ফস্টার ভবনের প্রতিটি নকশা তৈরিতে মানুষের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন। বাইরের সিঁড়ির বাঁকানো নকশা ও তির্যক প্রবেশপথ মানুষ কীভাবে স্থান ব্যবহার করে, সেই চিন্তাধারা থেকে এসেছে। ফস্টার নিজেই স্বীকার করেছেন—ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক পল রুডলফ, সের্গ চেরমায়েফ ও ভিনসেন্ট স্কালি তাঁকে বাস্তব, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে শিখিয়েছিলেন।

প্রযুক্তি ও মানবতার সেতুবন্ধন
জেপি মরগান চেজ যখন নরম্যান ফস্টারকে স্থপতি হিসেবে নির্বাচিত করে, তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু একটি অফিস টাওয়ার নয়, বরং এক নাগরিক প্রতীক গড়ে তোলা। এই ভবন শহরের ঐতিহ্যকে সম্মান জানায়, পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
৯০ বছর বয়সী ফস্টার প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহী হলেও মানবিক সংবেদনশীলতা কখনো হারাননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ম্যানচেস্টারে নাৎসি বোমা হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতাই তাঁকে এমন এক স্থাপত্য দর্শন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেছে, যেখানে প্রযুক্তি মানবতার সেবায় নিবেদিত।
এই ভবন সেই দর্শনেরই প্রতিফলন—একটি আধুনিক, মানবিক এবং সভ্য আকাশচুম্বী স্থাপনা।
#জেপিমরগানচেজ #নিউইয়র্কস্থাপত্য #নরম্যানফস্টার
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















