স্বৈরশাসক হলেও “জাতীয় বীর” স্বীকৃতি পেলেন সুহার্তো
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ানতো সোমবার প্রয়াত সাবেক স্বৈরশাসক ও তার সাবেক শ্বশুর সুহার্তেকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মানবাধিকার ও দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনগুলোর কঠোর আপত্তি উপেক্ষা করেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২০০৮ সালে ৮৬ বছর বয়সে মারা যাওয়া সুহার্তোকে নয়জন অন্য ব্যক্তির সঙ্গে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হয় রাজধানী জাকার্তায় রাষ্ট্রীয় প্রাসাদে আয়োজিত ‘ন্যাশনাল হিরোস ডে’ অনুষ্ঠানে।
৩২ বছরের কঠোর শাসন
সুহার্তো ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সালের মে মাস পর্যন্ত টানা ৩২ বছর ইন্দোনেশিয়া শাসন করেন। তার কঠোর শাসন, গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপ ও দুর্নীতির অভিযোগে তিনি বিতর্কিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া এশীয় আর্থিক সংকটের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য ও বিক্ষোভের মুখে ১৯৯৮ সালে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
রাষ্ট্র সচিব প্রাসেতিও হাদি বলেন, “আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের সম্মান জানাই—বিশেষ করে যেসব নেতা জাতির প্রতি অসামান্য অবদান রেখেছেন।”

দুর্নীতির অভিযোগ ও বিতর্ক
সুহার্তোকে বহু বছর ধরে জাতীয় বীর ঘোষণা করার দাবি উঠলেও বড় বাধা ছিল তার দুর্নীতির অভিযোগ। ২০০৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ঘোষণা করেছিল। তাদের হিসাব অনুযায়ী, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৫ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছিলেন।
তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ার সংসদীয় পরিষদের দুর্নীতিবিরোধী অধ্যাদেশ থেকে সুহার্তোর নাম মুছে দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুহার্তোর ভাবমূর্তি “ইতিবাচকভাবে পুনর্লিখনের” উদ্যোগ নেন। আগামী মাসে প্রকাশিত হতে যাওয়া নতুন “সরকারি ইতিহাস বইয়ে” সুহার্তোর শাসনামলকে “অর্জনের সময়” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রায় পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ক্ষোভ
২০০৩ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুহার্তোর শাসনামলে অন্তত ৩১ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন—যাদের মধ্যে অনেকেই নিহত, নির্যাতিত বা নিখোঁজ হয়েছিলেন। বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকের কমিউনিস্টবিরোধী অভিযান, ১৯৮০-এর দশকের রহস্যজনক গুলিবর্ষণ এবং ১৯৯৮ সালের দাঙ্গার সময় এসব সহিংসতা ঘটে।
মানবাধিকারকর্মী আনিতা ওয়াহিদ বলেন, “যিনি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন এবং সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করেছিলেন, তাকে জাতীয় বীর বলা মানে ভুক্তভোগীদের স্মৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।”

সরকারের যুক্তি
সংস্কৃতি মন্ত্রী ফাদলি জোন বলেন, “সুহার্তো জাতীয় বীর হওয়ার যোগ্য, কারণ তিনি ১৯৪৯ সালের ১ মার্চ যোগ্যাকার্তায় ডাচ দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কমান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।” তিনি আরও দাবি করেন, সুহার্তোর বিরুদ্ধে কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো বিচারিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
জোনের ভাষায়, “গণহত্যার কোনো প্রমাণ নেই।”
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার প্রতিক্রিয়া
ইন্দোনেশিয়ান করাপশন ওয়াচ (ICW) এই সিদ্ধান্তকে “স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক আলমাস স্যাফরিনা বলেন, “অনেকে বলেন সুহার্তো কখনো দোষী সাব্যস্ত হননি। কিন্তু সেটি প্রমাণের অভাবে নয়, বরং তদন্ত প্রক্রিয়া কখনো সম্পন্ন হয়নি বলেই।”
জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা
বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের বড় অংশ সুহার্তোর বীর মর্যাদার পক্ষে। জাকার্তাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কেদাইকোপির জরিপে ১,২০০ জন অংশগ্রহণকারীর প্রায় ৮০ শতাংশ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন, সুহার্তোর আমলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, উন্নয়ন, নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল।
![]()
পারিবারিক যোগসূত্র
প্রেসিডেন্ট প্রাবোও ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সুহার্তোর কন্যা সিতি হেদিয়াতি হারিয়াদি’র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাদের এক ছেলে রয়েছে—দিদিত হেদিপ্রাসেত্যো।
অন্যান্য যাঁরা বীর মর্যাদা পেয়েছেন
একই অনুষ্ঠানে আরও নয়জনকে জাতীয় বীর ঘোষণা করা হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুররহমান ওয়াহিদ, সাবেক প্রেসিডেন্ট সুশিলো বামবাং ইউদহয়োনোর শ্বশুর সারও এধি উইবোয়ো এবং ১৯৯৩ সালে নিহত শ্রমিক নেত্রী মারসিনাহ।
#ইন্দোনেশিয়া #সুহার্তো #জাতীয়বীর #মানবাধিকার #প্রাবোও
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















