সিঙ্গাপুরে কিডনি বিকলতার অর্ধেক ঘটনাই প্রতিরোধ করা সম্ভব—এমনটাই বলছেন চিকিৎসকরা। তাঁদের মতে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলো সময়মতো নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।
নীরব ঘাতক: প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হওয়াই ভাগ্য
৩৯ বছর বয়সী সায়াফিক ওমর সিঙ্গাপুরের ১৮ থেকে ৭৪ বছর বয়সী প্রায় পাঁচ লাখ কিডনি রোগীর একজন। সৌভাগ্যবশত, তাঁর রোগটি প্রাথমিক পর্যায়েই ধরা পড়ে এবং বর্তমানে তিনি ওষুধ সেবন করছেন।
ইন্টিমেডিকেল ক্লিনিকের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. অর্জুনান কুমারান তাঁকে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। পরীক্ষায় জানা যায়, সায়াফিকের কিডনি সমস্যার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস রয়েছে।
২০২৫ সালের মার্চে তিনি প্রথম পায়ে হালকা ঝিনঝিন অনুভব করেন, যা দুই মাস ধরে চলতে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করালে জানা যায়, তাঁর স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা (নিউরোপ্যাথি) হয়েছে। কিন্তু একই পরীক্ষায় আরও গুরুতর তথ্য বেরিয়ে আসে—কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কিডনি বিকলতার পরিণতি
কিডনি শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন কেন্দ্র, যা প্রতি মিনিটে প্রায় আধা কাপ রক্ত পরিশোধন করে। কিডনি কাজ বন্ধ করলে শরীরে ক্লান্তি, ফুলে যাওয়া, বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট ও বিভ্রান্তির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিডনি রোগকে “নীরব ঘাতক” বলা হয়, কারণ শুরুতে কোনো উপসর্গ থাকে না। যখন কিডনির কার্যক্ষমতা ১৫ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তখনই ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়।

অর্ধেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ সম্ভব
ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের (NKF) চিকিৎসা পরিচালক ডা. জেসন চু জানান, সিঙ্গাপুরে কিডনি রোগের প্রায় অর্ধেক ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য ছিল। তিনি বলেন, “যদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, অনেক রোগীই সুস্থ থাকতে পারতেন।”
যদিও ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না, তবে নতুন ওষুধ প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে কিডনির ক্ষতি অনেকটা ধীর করতে পারে।
স্বাভাবিকভাবে মানুষের কিডনি প্রতি বছর ০.৫% থেকে ১% পর্যন্ত দুর্বল হয়, কিন্তু ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) রোগীর ক্ষেত্রে তা ১০% পর্যন্ত নেমে আসে। পুরনো ওষুধ যেমন লসার্টান ব্যবহার করলে এই হার ৪%–এ নামানো যায়। নতুন ওষুধ SGLT2 ইনহিবিটরস ব্যবহার করলে তা আরও কমে ২%–এর কাছাকাছি হয়।
নতুন ওষুধে বাড়ছে আশার আলো
যাঁদের কিডনি ৬০% কাজ করছে (CKD 2), তাঁদের পুরনো ওষুধে ১২ বছরের মধ্যে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু নতুন ওষুধ ব্যবহারে এই সময় ২৩ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ডা. কুমারান জানিয়েছেন, সায়াফিককে ইতিমধ্যে SGLT2 ইনহিবিটরস দেওয়া হয়েছে, যা হৃদপিণ্ড ও কিডনি দুটিকেই সুরক্ষা দেয়। ডা. চু আরও বলেন, “ডায়ালাইসিসে থাকা প্রতি তিনজনের একজন হৃদরোগে মারা যান।”
কারা ঝুঁকিতে?
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান বা দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ (যেমন ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক, অ্যাসপিরিন) সেবনকারীরা কিডনি পরীক্ষার আওতায় আসা উচিত।
NKF-এর ২০০টিরও বেশি ক্লিনিকে বিনামূল্যে কিডনি পরীক্ষা করা যায়, যা সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ ডলার খরচ হয়।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন জরুরি
ডা. চু বলেন, “অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কিডনি বিকলতার বড় ঝুঁকি তৈরি করে।”
তিনি পরামর্শ দেন, লবণ খাওয়া দিনে ২ গ্রামের নিচে রাখা উচিত, এতে রক্তচাপ ও শরীরে পানি জমা কমে, ফলে কিডনির ওপর চাপ কমে।
CKD 3 ও CKD 4 রোগীদের জন্য প্রোটিন কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়—শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন যথেষ্ট। অর্থাৎ ৬০ কেজি ওজনের একজনের জন্য দৈনিক ৪৮ গ্রাম প্রোটিনই যথেষ্ট।
তিনি আরও বলেন, “উদ্ভিদজাত প্রোটিন কিডনিতে চাপ কমায় এবং পেটের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, যেখানে লাল মাংসের মতো প্রাণিজ প্রোটিন কিডনিকে বেশি ক্ষতি করে।”
২০০ গ্রাম স্টেকে থাকে প্রায় ৫০ গ্রাম প্রোটিন, আর একটি ৫০ গ্রাম ওজনের ডিমে থাকে মাত্র ৬ গ্রাম প্রোটিন।
প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা
NKF, যারা দেশের প্রায় ৬০% কিডনি বিকল রোগীর যত্ন নেয়, তারা এখন প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিচ্ছে।
NKF চেয়ারম্যান অং হাও ইয়াও বলেন, “কিডনি বিকলতা অনিবার্য নয়। এটি সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে চলা নীরব রোগের ফল। আমাদের আসল সুযোগটি ‘আপস্ট্রিমে’—অর্থাৎ আগেভাগেই প্রতিরোধে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন শুধু চিকিৎসা নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে স্ক্রিনিং, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতন জীবনযাপনে জোর দিচ্ছি। লক্ষ্য একটাই—সিঙ্গাপুরবাসীকে যতদিন সম্ভব সুস্থ রাখা।”
ডায়াবেটিস: মূল অপরাধী
সিঙ্গাপুরে কিডনি রোগের দুই-তৃতীয়াংশই ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কিত। তুলনায় নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিতে এই হার এক-পঞ্চমাংশেরও কম।

এই কারণেই ২০২৪ সালের মার্চে NKF ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে কিডনি স্ক্রিনিং কর্মসূচি চালু করে। এখন পর্যন্ত ৫,৭০০ জনের মধ্যে ১৫ শতাংশের ফল অস্বাভাবিক এসেছে।
NKF-এর প্রধান নির্বাহী ইয়েন তান বলেন, “এটি HealthierSG পরিকল্পনার অংশ। আমরা এখন স্বাস্থ্য ক্লাস্টারগুলোর সঙ্গে তথ্য ভাগ করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করার দিকে কাজ করছি।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের “ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” উদ্যোগ ইতিমধ্যেই ফল দিয়েছে—ডায়াবেটিসজনিত কিডনি বিকলতার হার ২০১৯ সালের ৬৮% থেকে ২০২৪ সালে কমে ৬৩%-এ নেমে এসেছে।
জাতীয় স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ দুটোই আছে, তাঁদের অর্ধেকের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু ডায়াবেটিস থাকলে ঝুঁকি ৩৪.৪%, কেবল উচ্চ রক্তচাপে ২১.৪%, আর দুটোই না থাকলে মাত্র ৬.৩%।
তবে জরিপে দেখা গেছে, ১৬.৫% ডায়াবেটিস রোগী জানেনই না যে তাঁদের এই রোগ আছে। যাঁরা জানেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনের রোগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের—তাঁদের ৮১.৫% এর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই।
ডায়ালাইসিসের কঠিন বাস্তবতা
৫৫ বছর বয়সী লিম চি মেং টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে গত ছয় বছর ধরে আলজুনায়েড সেন্টারে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। তাঁর হাতে তৈরি আর্টেরিওভেনাস ফিস্টুলা দিয়ে প্রতিদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “আমি আজও বেঁচে আছি চিকিৎসকদের জন্য কৃতজ্ঞ, কিন্তু যদি আগে জানতাম, হয়তো এ পর্যায়ে আসতাম না।”
#health #kidneydisease #Singapore #Diabetes #NKF #সারাক্ষণ-রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















