দিল্লির লালকেল্লা সংলগ্ন এলাকায় গাড়ি বিস্ফোরণের পর কাশ্মিরি চিকিৎসক উমর উন নাবির ভূমিকা নিয়ে তদন্ত সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তার শেষ দিনের গতিবিধি, যোগাযোগ ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক যোগসূত্র খতিয়ে দেখে পুরো ঘটনার প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচনে তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই রাজ্য থেকে অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। পাশাপাশি, উমর কি কোনও অজ্ঞাত সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন কি না—তা তদন্তকারীরা বিস্তারিতভাবে যাচাই করছেন।
বিস্ফোরণে ব্যবহৃত গাড়ি ও বিস্ফোরক
তদন্তকারীরা উমর ও গ্রেপ্তার হওয়া চিকিৎসক ড. শাহীন শাহিদের মালিকানাধীন বলে দাবি করা চারটি গাড়িকে নজরে এনেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মেওয়াট ও ফারিদাবাদের সার দোকান এবং খনি-মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
পোড়া গাড়ি থেকে ডিটোনেটর, রিমোট টাইমার, ব্যাটারি এবং রাসায়নিক দ্রব্যের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। এতে প্রমাণ মিলেছে, উমর গাড়ির ভেতরেই তাৎক্ষণিকভাবে আইনসঙ্গত উপাদান ব্যবহার করে আইইডি তৈরি করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও নির্দেশনা
তদন্তে জানা গেছে, উমর ও তার সহযোগী মুজাম্মিল শাকিল গনাই ২০২১–২২ সালে পরিচিত হন। গত তিন–সাড়ে তিন বছরে তারা তুরস্ক, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভ্রমণ করেন।

স্পেশাল সেলের এক কর্মকর্তা জানান:
- • ২০২২ সালে তুরস্কে তারা জেইশ-ই-মোহাম্মদের ‘হ্যান্ডলার’-দের সঙ্গে দেখা করেন।
- • ‘সিগন্যাল’ ও ‘টেলিগ্রাম’ অ্যাপের তথ্য থেকে নিশ্চিত হয়েছে যে তারা নিয়মিত নির্দেশনা পেতেন।
- • ড. উকাশা ও ড. হাশিম নামে দুই ব্যক্তির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। এই নামগুলো আসল নাকি ছদ্মনাম—তা এখনও পরিষ্কার নয়।
- • তহবিল সংগ্রহ নিয়ে উমর ও অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধও তৈরি হয়েছিল।
তদন্তকারীরা সন্দেহ করছেন, ‘হাশিম’ আসলে আগে গ্রেপ্তার হওয়া আরিফ নিসার হতে পারেন।
আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত
হারিয়ানা ভিত্তিক আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেন ও নথিপত্রের ফরেনসিক অডিট করা হবে। এখানে কয়েকজন অভিযুক্ত কাজ করতেন। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটসহ অন্যান্য সংস্থাকেও তদন্তে যুক্ত করা হয়েছে।
গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন—যারা এই কাপুরুষোচিত হামলার সঙ্গে যুক্ত, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
বিস্ফোরণের ঘটনা
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে নেটাজি সুভাষ মার্গে একটি সাদা i২০ গাড়ি বিস্ফোরিত হয়। বহুবার মালিকানা বদলানো ও সিএনজি রূপান্তর করা এই গাড়িটি বিস্ফোরণে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জন মারা গেছেন এবং ২১ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।

তদন্তে পাওয়া তথ্য:
- • গাড়িটি রবিবার মধ্যরাতে মেওয়াটের ধৌজ টোল প্লাজা পার হয়।
- • রাত ১টা ৩৭ মিনিটে নুহ–ফেরোজপুর ঝিরকা টোল পার করে।
- • সোমবার ভোরে দিল্লি–মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করে।
- • গাড়িতে পুরো রাত কাটায় এবং সকালে ফারিদাবাদ–দিল্লি রুটে চলে।
উমরই চালাচ্ছিলেন বিস্ফোরকবাহী গাড়ি—ডিএনএ মিল
গাড়ির প্যাডেলে পাওয়া বিচ্ছিন্ন পায়ের ডিএনএ নমুনা উমরের মায়ের নমুনার সঙ্গে মিলেছে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে—বিস্ফোরণের সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন উমর নিজেই।
বিস্ফোরকের উৎস ও সম্ভাব্য বড় পরিকল্পনা
২,৯০০ কেজি–র মতো অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার হওয়ার পর তদন্তকারীরা মনে করছেন—আরও বড় হামলার পরিকল্পনা ছিল।
হারিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও কাশ্মিরে অভিযান চালিয়ে যাদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন—
- • তিন চিকিৎসক
- • একজন মৌলভি
- • আল ফালাহ মসজিদের ইমাম হাফিজ মোহাম্মদ ইশতিয়াক
- • শাহীদ শাহিদের ভাই পারভেজ সাঈদ আনসারি
- • আরও কয়েকজন সন্দেহভাজন

উমরের শেষ দিনের গতিবিধি
তদন্তের মূল লক্ষ্য এখন—উমরের শেষ দিনের রহস্য উদ্ঘাটন।
মূল প্রশ্ন:
১. দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে তিনি কি তুর্কমান গেটের ফয়েজ ইলাহি মসজিদে কারও সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
২. দিল্লির ভেতর ঘুরে বেড়ানোর সময় কি কেউ তাকে নির্দেশ দিচ্ছিল?
তদন্তে যা পাওয়া গেছে:
- • ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
- • বেলা ২টার দিকে তিনি কনট প্লেসের ই-ব্লকের কাছে গাড়ি থামিয়ে ১০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করেন।
- • ২টা ৩০ মিনিটে তাকে তুর্কমান গেট মসজিদে ঢুকতে দেখা যায়, ১৫ মিনিট পরে বেরিয়ে আসেন।
- • পুলিশের ধারণা—তিনি নিজের ফোন বা অন্য কারও ফোন ব্যবহার করে ‘হ্যান্ডলার’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
মসজিদের কর্মীরা জানিয়েছেন, পুলিশ সিসিটিভি ডিভিআর জব্দ করেছে এবং তারা তদন্তে সহযোগিতা করছেন।
বিস্ফোরণটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সম্ভাব্য বড় নাশকতামূলক নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। উমর নাবির শেষ দিনের গতিবিধি, দেশ–বিদেশে তার যোগাযোগ এবং উদ্ধার হওয়া নানা প্রমাণ—সব মিলিয়ে একটি বড় চক্রের ইঙ্গিত মিলছে, যার সম্পূর্ণ রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















