বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ তৈরি হয়েছে—যখন বিশ্বজুড়ে সঙ্গীত শিক্ষাকে শিশুদের বুদ্ধিবিকাশ ও মানসিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে যেখানে সঙ্গীত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে তা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকেই “পেছনের দিকে হাঁটা” বলে সমালোচনা করছেন।
পুলিশের বাধায় উদীচির সঙ্গীত মিছিল থেমে গেল
রবিবার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজিত সঙ্গীতমিছিল পুলিশ থামিয়ে দেয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়।
মিছিল শিল্পকলা একাডেমির কাছে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। শিল্পীরা জানান, তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে গিয়ে গান পরিবেশন করতে চেয়েছিলেন। প্রথমে পুলিশ মিছিল এগিয়ে যেতে দিলেও দুই মিনিট পর আবার থামিয়ে দেয়। বাধা সত্ত্বেও শিল্পীরা রাস্তায় বসে গান পরিবেশন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
২ নভেম্বর প্রকাশিত সংশোধিত নিয়মে সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাতিল করা হয়।
মন্ত্রণালয় জানায়, সারা দেশের ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় অল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ অকার্যকর হবে। একজন শিক্ষককে ২০ বা তার বেশি স্কুলে পাঠানো বাস্তবসম্মত নয়।

আগস্টে প্রকাশিত নিয়মে এই দুই পদের উল্লেখ ছিল, কিন্তু দুই মাসের মধ্যেই তা বাতিল করা হয়। দেশজুড়ে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে। মানবাধিকার ফোরাম বাংলাদেশ (HRFB) সিদ্ধান্তটিকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদও তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ছায়ানট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থান
ছায়ানট শনিবার গান পরিবেশন করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন ও গান পরিবেশন করেন। বিভাগীয় চেয়ারপারসন ড. প্রিয়াঙ্কা গোপ স্মারকলিপি পাঠ করেন। বিভিন্ন হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদকরাও সমর্থন জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের শিল্পচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য বড় হুমকি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।
বিশ্ব প্রবণতা: সঙ্গীত শিক্ষায় এগিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোও
সৌদি আরব ভিশন ২০৩০ সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রকাশ্য স্কুলে সঙ্গীত শিক্ষা চালু করেছে। ইতোমধ্যে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাজারো কিন্ডারগার্টেন শিক্ষককেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও মিশরেও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পাঠ্যক্রমে সঙ্গীত বাধ্যতামূলক।
মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৭০-এর দশক থেকে সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ২০২২ সালের পাঠ্যক্রমেও তা বজায় আছে।
তুরস্কে ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
মিশরে ১৯৩১ সাল থেকে সরকারি স্কুলে আরবি ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষা চালু।
যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা—এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক বা ব্যাপকভাবে অনুসৃত।
চীনে বাধ্যতামূলক শিক্ষার পুরো নয় বছর জুড়েই সঙ্গীত একটি আবশ্যিক বিষয়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আপত্তি
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করছে। তারা ধর্মীয় শিক্ষকের দাবি জানিয়ে রাস্তায় নামার হুমকি দিয়েছে।
সেপ্টেম্বরে ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের অডিটোরিয়ামে এই দাবিতে সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়।

এমআইটি গবেষণা: সঙ্গীত শেখা বুদ্ধিবিকাশে অসাধারণ ভূমিকা রাখে
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT)-এর নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে—সঙ্গীত শেখা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
সঙ্গীত শেখা মস্তিষ্কের স্মৃতি, মনোযোগ, সমস্যা সমাধান ও ভাষাগত দক্ষতা উন্নত করে। গণিত ও যুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত অংশগুলোও সক্রিয় হয়।
সঙ্গীত সৃজনশীলতা, প্যাটার্ন চেনা ও আবেগ প্রকাশ—সবকিছুকে একত্রিত করে, যা শিশুদের মানসিক সক্ষমতা বাড়ায়।
গবেষকরা জানান, সঙ্গীতচর্চা শিশুদের সামাজিক দক্ষতা, দলগত কাজ, ধৈর্য ও যোগাযোগ—এসব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটায়। ফলে তারা আরও আত্মবিশ্বাসী, অভিযোজনক্ষম এবং ভবিষ্যতের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সফল হতে পারে।
#tag: সঙ্গীত_শিক্ষা বাংলাদেশ_প্রাথমিক_শিক্ষা শিক্ষক_নিয়োগ উদীচী ঢাকা_বিশ্ববিদ্যালয় ছায়ানট বিশ্ব_পাঠ্যক্রম MIT_গবেষণা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















