হ্যাবিট্যাট: ভেতরে হাসি, বাইরে আতঙ্ক
মুম্বাইয়ের কমেডি ক্লাব ‘হ্যাবিট্যাট’ বাইরে থেকে সাধারণ বন্ধ দোকানের মতো দেখায়, কোনো সাইনবোর্ড নেই, ব্যস্ত রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে হাঁটলে কেউ টেরই পাবে না ভেতরে কী চলছে। শো শুরুর একটু আগে তরুণ পেশাজীবীদের ভিড়ই জানান দেয় এখানে হাসির মহড়া চলছে। ভেতরে ছোট মঞ্চে ইংরেজি–হিন্দি মিশিয়ে পারফর্ম করেন কমেডিয়ানরা, প্রথমে নিবেদিতা প্রকাশম দর্শকদের সঙ্গে প্রাণবন্ত আলাপ জমিয়ে মঞ্চ মাতান, এরপর ধারাবাহিকভাবে অন্য শিল্পীরা তাদের সংক্ষিপ্ত পরিবেশনা করেন।
বারবার হামলার শিকার কমেডি ক্লাব
আর্থিকভাবে সফল হলেও হ্যাবিট্যাট বারবার উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর হামলার মুখে পড়ে। মালিক বালরাজ সিং ঘাই বাড়তি চাহিদায় স্থান বাড়ালেও ক্লাবকে আড়ালে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। মার্চ মাসের শেষ হামলাটি হয় কুনাল কামরার একটি শোকে ঘিরে, যেখানে তিনি মহারাষ্ট্রের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে ‘গাদ্দার’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
কমেডি: জনপ্রিয় কিন্তু ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ
ভারতে কমেডি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন, আবার একই সঙ্গে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বির দাস “টু ইন্ডিয়াস” বক্তব্য দেওয়ার পর হাজারো মৃত্যু-হুমকির মুখে পড়েন। মুনাওয়ার ফারুকির বিরুদ্ধে “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” অভিযোগ এনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, এমনকি তাকে হত্যার পরিকল্পনাও করা হচ্ছিল। কুনাল কামরা বলেন, দেশজুড়ে কমেডিয়ানদের জন্য পরিবেশ ক্রমেই “শ্বাসরুদ্ধকর” হয়ে উঠছে; হামলার পর তিনি পুদুচেরিতে গিয়ে জনসমক্ষে পারফরমেন্স কমিয়ে দেন। তার মতে, কমেডিয়ানদের শক্তির বড় অংশ ব্যয় হয় এই ভাবনায়—কার রসিকতায় কারা ক্ষুব্ধ হতে পারে।

মতপ্রকাশের সংকট
বিশ্লেষকদের মতে নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে শিল্পী, সাংবাদিক ও সমালোচকদের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। ফ্রিডম হাউস ভারতের অবস্থানকে “আংশিক স্বাধীন” হিসেবে উল্লেখ করে। সংবিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিলেও “শালীনতা, নৈতিকতা ও জনশৃঙ্খলা”র অজুহাত দেখিয়ে সেটিকে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগও আছে। ব্যক্তিগত মর্যাদার অধিকারের ব্যাখ্যা এমন জায়গা তৈরি করেছে যেখানে যে কেউ কোনো রসিকতাকে ‘মর্যাদাহানির’ অভিযোগে মামলা করতে পারে। এতে প্রতিটি অভিযোগে তদন্ত, সময় ও অর্থখরচসহ মানসিক চাপের বোঝা বহন করতে হয় কমেডিয়ানদের।
কমেডি কেন এত জনপ্রিয়
যারা কমেডিয়ানদের মুখ বন্ধ করতে চায় তাদের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ কমেডিকে ভালোবাসে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ভারতীয় দর্শকদের শীর্ষ পছন্দ এখন কমেডি ঘরানা, বহু স্ট্যান্ড-আপ শিল্পী বিশ্বজুড়ে হাউসফুল শো করেছেন, আর কপিল শর্মার জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক তারকাদের চেয়েও বেশি—ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারীর সংখ্যা কয়েক কোটি। তার শোও নেটফ্লিক্সে নতুন সিজন নিয়ে ফিরেছে।
বির দাস: ওপেন-মাইক থেকে বিশ্বভ্রমণ
বির দাস নিজের আত্মজীবনীতে ভারতের আধুনিক কমেডি জগতের উত্থান তুলে ধরেছেন। ২০০০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি মুম্বাইয়ে প্রথম ইংরেজি ওপেন-মাইক আয়োজন করেন, সেখান থেকেই চলচ্চিত্র, বিদেশ সফর, নেটফ্লিক্স স্পেশাল—সবই আসে। কোভিডের সময় তিনি গোয়ার একটি গ্রামে ছোট ছোট আউটডোর শো করতে শুরু করেন, সেখান থেকেই ‘টেন অন টেন’ সিরিজ জন্ম নেয়—দর্শকের প্রস্তাবিত বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক পরিবেশনা। তার রসিকতায় থাকে একদিকে সামাজিক বিশ্লেষণ, অন্যদিকে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা।
হলিউডে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত
বির দাস মনে করেন, হলিউডে গেলে তাকে সীমিত ও ক্লিশে ভারতীয় চরিত্রে আটকে রাখা হতো—দুই দৃশ্যের ডেলিভারি বয় বা খোলামেলা অথচ রক্ষণশীল অ্যাকাউন্ট্যান্টের মতো ভূমিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হতো।

কমেডিয়ানদের দায়িত্ববোধ
ডকুমেন্টারি নির্মাতা বিনয় শুক্লা বলেন, গত দশ বছরে কমেডিয়ানরা অন্য শিল্পের চেয়ে বেশি মুক্তভাবে ক্ষমতার সমালোচনা করেছেন। কারণ সিনেমা–নাটক করতে তহবিল, দল ও সেন্সরের অনুমতি লাগে, কিন্তু কমেডিতে লাগে একজন শিল্পী ও একটি মাইক্রোফোন। সোশ্যাল মিডিয়া এই শক্তিকে আরও বিস্তৃত করেছে—একটি ছোট মঞ্চ থেকে বলা কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ঝুঁকি নিয়েই মঞ্চে ওঠেন কুনাল কামরা
কামরা জানান, ঝুঁকিই তাকে বারবার মঞ্চে টেনে আনে—যে কথা অন্যরা বলতে ভয় পায়, সেটাই বলার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। অবিবাহিত হওয়ায় তার ব্যক্তিগত ঝুঁকি তুলনামূলক কম হলেও তিনি মনে করেন, কঠিন বিষয় সহজ করে বলার মাধ্যমে জনআলোচনার পরিসর বাড়ানোই কমেডির কাজ। তার সতর্কতা—এখন সবাই সাংস্কৃতিক পুলিশ সেজে আছে, কোনো একদিন আপনি নিজের মত বললে কেউ আহত দাবি করে আপনাকেও একই রকম বিপদে ফেলতে পারে।
#ভারত #কমেডি #মতপ্রকাশ #হাস্যরস #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















