০৭:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
নতুন বন্যায় ডুবে ভিয়েতনাম, ঝুঁকিতে কফি ফসল ও গ্রামীণ জীবন লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা ‘আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে’ ‘সুইম শেডি’ নাম নিয়ে আইনি লড়াইয়ে এমিনেম দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের উপকূলীয় শহর ওওইতায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুড়ল শতাধিক ঘর বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুতে এগোচ্ছে জাপান গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না, এবার রবির বিরুদ্ধে অভিযোগ — জিপি ও বাংলালিংকের আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে শিশু নিরাপত্তা জোরদারের প্রতিশ্রুতি ভারতের স্পষ্ট বার্তা: যেখানেই হোক, সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালানোর পূর্ণ অধিকার আছে ইভি আর স্মার্ট গ্যাজেটের জোরে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা দেখাল শাওমি

‘আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে’

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া

রায়পুর শহরের অওধিয়া পাড়ার গলি- তস্য গলির ভেতরে এক জরাজীর্ণ বাড়ি। এই বাড়িতেই বাস করেন ৮৪ বছরের জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া।

প্রায় ভেঙে পড়া এই বাড়ির দরজায় কোনো নামফলক নেই, গরহাজির কোনো বিজয়ের চিহ্নও। কিন্তু যদি বাড়িটির দেওয়ালগুলো কথা বলতে পারত, তাহলে হয়ত শোনা যেত সুবিচার পাওয়ার আশায় ৩৯ বছর ধরে কীভাবে এক ব্যক্তি আদালতের দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন।

এখন যখন সেই দরজা খুলেছে, ততদিনে তার জীবনের প্রায় সব জানালাই বন্ধ হয়ে গেছে।

অবিভক্ত মধ্য প্রদেশের রাজ্য সড়ক পরিবহন করপোরেশনে ক্লার্কের পদে চাকরিরত জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়াকে ১৯৮৬ সালে একশ ভারতীয় টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এখন, প্রায় ৩৯ বছর পরে আদালত তাকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে।

সরকারি নিয়মের উদাসীনতা, বিচারে বিলম্ব আর একজন মানুষের আশাহত হওয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছেন জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া।

তিনি বলছিলেন, “এই রায়ের এখন আর কোনও অর্থ হয় না। চাকরি গেছে। সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারিনি, তাদের বিয়ে দিতে পারিনি। আত্মীয়রা দূরে সরে গেছে। চিকিৎসার অভাবে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এই সময়কালটা কি কেউ আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে?”

মনে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বলছিলেন যে ”হাইকোর্ট তো নির্দোষ বলল, কিন্তু আমার পুরো পরিবার গত ৩৯ বছর ধরে যা সহ্য করেছে, সেই ভারী বোঝার তুলনায় আদালতের এই প্রমাণপত্র তো অনেক হালকা”।

"আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে"

                           “আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে”

ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলাম’

কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে থম মেরে বসে থাকেন জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া, যেন অনেক দিন ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। পুরানো ফাইল খুলে হলুদ হয়ে আসা কিছু কাগজ দেখাচ্ছিলেন। বিবর্ণ হয়ে আসা একেকটা পাতা যেন গত ৩৯ বছরের একেকটা দিনের কাহিনি।

নিচু স্বরে তিনি বলছিলেন, “আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে। এখন কাকে বলব যে আমি নির্দোষ ছিলাম? আমার কথা শোনার জন্য কেউই তো নেই আর। আমার পুরো জীবনটাই চলে গেল এটা প্রমাণ করতে যে আমি নির্দোষ। এখন তা যখন প্রমাণিত হলো, তখন তো সব হারিয়েছি – বয়সও চলে গেছে।”

আদালতের নথি বলছে রাজ্য সড়ক পরিবহন করপোরেশনে বিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কর্মরত জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়াকে ১০০ টাকা ঘুষ সহ পাড়ার মোড় থেকে গ্রেফতার করেছিল লোকায়ুক্তের একটি দল।

ভারতে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি ধরার জন্য ‘লোকায়ুক্ত’ নিযুক্ত করার আইন আছে। রাজ্য সরকারগুলো ‘লোকায়ুক্ত’ নিযুক্ত করে, তবে অনেক রাজ্যেই এই পদ সৃষ্ট করেনি।

আবার সর্বভারতীয় স্তরে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই-ও একইভাবে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে গ্রেফতার করতে পারে।

মি. অওধিয়া বলছিলেন, “একজন কর্মী তার বকেয়া পাওনার বিল বানানোর জন্য আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে ওপর মহল থেকে লিখিত নির্দেশ আসার পরেই ফাইল আমার কাছে আসবে, তারপরেই বিল বানাতে পারব আমি। এরপরে ওই কর্মী আমাকে ২০ টাকা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি রেগে গিয়ে তাকে ফের আমার অফিসে আসতে বারণ করি।”

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়ার দাবি যে ওই কর্মীর বোধহয় তার কথায় খারাপ লেগেছিল। সে তার পুলিশ কর্মী বাবাকে কিছু একটা বলে থাকবে। এই ঘটনার তিনদিন পরে আমি যখন অফিসে যাচ্ছি, তখন ওই কর্মী পিছন দিক থেকে এসে আমার পকেটে কিছু একটা গুঁজে দেয়।

মি. অওধিয়ার কথায়, “আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে আমাকে আটক করে বলে যে তারা দুর্নীতি দমন বিভাগের লোক আর আমাকে ১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

বাবার গ্রেফতারির সময় নীরজের বয়স ছিল ১৩, এখন তিনি ৫২

বাবার গ্রেফতারির সময় নীরজের বয়স ছিল ১৩, এখন তিনি ৫২

সেদিন থেকেই শাস্তির শুরু

জাগেশ্বর প্রসাদ বলছিলেন, ওই দিন থেকে শুধু তার নয়, পুরো পরিবারের শাস্তি পাওয়ার শুরু।

গ্রেফতার হওয়ার দুই বছর পরে আদালতে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হলে তাকে ১৯৮৮ সালে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সাসপেনশান চলে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এরপরে তাকে রায়পুর থেকে রেওয়া বদলি করে দেওয়া হয়।

তার অর্ধেক বেতন – মাত্র আড়াই হাজার ভারতীয় টাকায় সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী আর চার সন্তান রায়পুরেই থেকে যান, আর মি. অওধিয়া রেওয়াতে। পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি – সবই বন্ধ হয়ে যায়। এক এক করে চার সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

তার ছোট ছেলে নীরজ অওধিয়ার বয়স সেই সময়ে ছিল মাত্র ১৩ বছর। এখন ৫২ বছরের নীরজের আফসোস যে তার বাবার জীবনযুদ্ধ যে শুধু তাদের ছোটোবেলাটা আদালতের সিঁড়িতেই কেটেছে।

চোখের কোণে জমে ওঠা জল মুছে নীরজ বলছিলেন, “আমি তো তখন ঘুষ নেওয়ার মানেই বুঝতাম না, কিন্তু লোকে বলত ঘুষখোরের ছেলে। ছোটরা পেছনে লাগত। স্কুলে কোনও বন্ধু হয়নি, পাড়ায় সবাই দরজা বন্ধ করে দিত। আত্মীয়রা সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল। স্কুলের বেতন দিতে পারতাম না বলে বেশ কয়েকবার স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

জাগেশ্বর অওধিয়ার স্ত্রী ইন্দু অওধিয়া এই পুরো বোঝাটা নিজের ভেতরেই বইতেন। ধীরে ধীরে তিনিও এই সামাজিক শাস্তির চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে ২৪ দিন ভর্তি থাকার পরে সেখানেই তিনি মারা যান। পেছনে ফেলে রেখে যান একটি ভেঙে যাওয়া পরিবার।

জাগেশ্বর প্রসাদ বলছিলেন, “আমার স্ত্রী শুধু দুশ্চিন্তা করতে করতে চলে গেল। আমার ওপরে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আর তারপরে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পরে ও দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগছিল। ও ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল। আমার কাছে অর্থ ছিল না যে আমি ঠিকমতো ওর চিকিৎসা করাব। আমার মনে আছে যেদিন ও চলে গেল, অন্তিম সংস্কার করারও পয়সা ছিল না আমার কাছে। এক বন্ধু তিন হাজার টাকা দিয়েছিল, তা দিয়ে কোনোভাবে অন্তিম সংস্কার আর অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম সেরেছিলাম।”

'এই বয়সে যাতে আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়'

‘এই বয়সে যাতে আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়’

‘যাতে আর হাত না পাততে হয়’

বিচারিক আদালত ২০০৪ সালে মি. অওধিয়াকে দোষী বলে ঘোষণা করে। তবে সব সাক্ষীরাই নিজেদের বয়ান বদল করে ফেলেছিল। তা স্বত্বেও আদালত একবছরের জেল আর এক হাজার ভারতীয় টাকার জরিমানার আদেশ দেয়।

তবে তিনি হার মেনে নেননি। হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি, সেখানে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলা চলে।

সংসার চালানোর জন্য তিনি একেকবার একেক ধরনের কাজ করেছেন। কখনও ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে, কখন কোনও বাস মালিকের কাছে। বয়স হয়ে যাওয়া স্বত্বেও আট থেকে দশ ঘণ্টা কাজ করতে হত তাকে। মাত্র একশ টাকার অভিযোগে তাকে প্রায় ১৪ হাজার দিন অদৃশ্য এক কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে।

শেষমেষ ২০২৫ সালের সেই দিনটা এসেছিল, যেদিন হাইকোর্ট ঘোষণা করল যে তিনি নির্দোষ।

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া বলছিলেন, “ন্যায় বিচার তো পেলাম, কিন্তু সময়টা তো ফিরে আসবে না। স্ত্রীকে তো ফিরে পাব না, সন্তানদের ছোটোবেলাটা তো আর ফিরবে না।

“আর মান-সম্মান! সেটাও তো ফিরে পাইনি।”

হাইকোর্টের আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা শুক্লা বলছিলেন, ‘মি. অলিয়া এখন এই মামলায় ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নটা হলো অর্থ দিয়ে কি তার ভাঙাচোরা জীবনটা আর জোড়া লাগবে? ক্ষতিপূরণ দিয়ে কি তার চলে যাওয়া সময়টা আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? জাগেশ্বর প্রসাদের কাহিনি শুধু একজন ব্যক্তির ট্র্যাজেডি নয়। আমাদের গোটা বিচার ব্যবস্থার চেহারা সামনে এনে দিল – যে ব্যবস্থা আবার বিচারে বিলম্ব হওয়াকে অবিচার বলে মনে করে। কারও যৌবন আদালতে কাটছে তো কারও বার্ধক্য। আর যখন ফয়সালা হচ্ছে, ততক্ষণে অনেক কিছু শেষ হয়ে গেছে।”

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া এখন চান যে সরকার অন্তত তার পেনশন আর বকেয়াটুকু মিটিয়ে দিক।

জীবনভর পরিশ্রম করার পরে এখন কারও কাছে যাতে আর হাত না পাততে হয়।

 

বিবিসি নিউজ হিন্দি, রায়পুর (ছত্তিশগড়)

জনপ্রিয় সংবাদ

নতুন বন্যায় ডুবে ভিয়েতনাম, ঝুঁকিতে কফি ফসল ও গ্রামীণ জীবন

‘আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে’

০৫:৩৪:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

রায়পুর শহরের অওধিয়া পাড়ার গলি- তস্য গলির ভেতরে এক জরাজীর্ণ বাড়ি। এই বাড়িতেই বাস করেন ৮৪ বছরের জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া।

প্রায় ভেঙে পড়া এই বাড়ির দরজায় কোনো নামফলক নেই, গরহাজির কোনো বিজয়ের চিহ্নও। কিন্তু যদি বাড়িটির দেওয়ালগুলো কথা বলতে পারত, তাহলে হয়ত শোনা যেত সুবিচার পাওয়ার আশায় ৩৯ বছর ধরে কীভাবে এক ব্যক্তি আদালতের দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন।

এখন যখন সেই দরজা খুলেছে, ততদিনে তার জীবনের প্রায় সব জানালাই বন্ধ হয়ে গেছে।

অবিভক্ত মধ্য প্রদেশের রাজ্য সড়ক পরিবহন করপোরেশনে ক্লার্কের পদে চাকরিরত জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়াকে ১৯৮৬ সালে একশ ভারতীয় টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এখন, প্রায় ৩৯ বছর পরে আদালত তাকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে।

সরকারি নিয়মের উদাসীনতা, বিচারে বিলম্ব আর একজন মানুষের আশাহত হওয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছেন জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া।

তিনি বলছিলেন, “এই রায়ের এখন আর কোনও অর্থ হয় না। চাকরি গেছে। সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারিনি, তাদের বিয়ে দিতে পারিনি। আত্মীয়রা দূরে সরে গেছে। চিকিৎসার অভাবে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এই সময়কালটা কি কেউ আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে?”

মনে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বলছিলেন যে ”হাইকোর্ট তো নির্দোষ বলল, কিন্তু আমার পুরো পরিবার গত ৩৯ বছর ধরে যা সহ্য করেছে, সেই ভারী বোঝার তুলনায় আদালতের এই প্রমাণপত্র তো অনেক হালকা”।

"আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে"

                           “আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে”

ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলাম’

কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে থম মেরে বসে থাকেন জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া, যেন অনেক দিন ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। পুরানো ফাইল খুলে হলুদ হয়ে আসা কিছু কাগজ দেখাচ্ছিলেন। বিবর্ণ হয়ে আসা একেকটা পাতা যেন গত ৩৯ বছরের একেকটা দিনের কাহিনি।

নিচু স্বরে তিনি বলছিলেন, “আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে। এখন কাকে বলব যে আমি নির্দোষ ছিলাম? আমার কথা শোনার জন্য কেউই তো নেই আর। আমার পুরো জীবনটাই চলে গেল এটা প্রমাণ করতে যে আমি নির্দোষ। এখন তা যখন প্রমাণিত হলো, তখন তো সব হারিয়েছি – বয়সও চলে গেছে।”

আদালতের নথি বলছে রাজ্য সড়ক পরিবহন করপোরেশনে বিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কর্মরত জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়াকে ১০০ টাকা ঘুষ সহ পাড়ার মোড় থেকে গ্রেফতার করেছিল লোকায়ুক্তের একটি দল।

ভারতে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি ধরার জন্য ‘লোকায়ুক্ত’ নিযুক্ত করার আইন আছে। রাজ্য সরকারগুলো ‘লোকায়ুক্ত’ নিযুক্ত করে, তবে অনেক রাজ্যেই এই পদ সৃষ্ট করেনি।

আবার সর্বভারতীয় স্তরে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই-ও একইভাবে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে গ্রেফতার করতে পারে।

মি. অওধিয়া বলছিলেন, “একজন কর্মী তার বকেয়া পাওনার বিল বানানোর জন্য আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে ওপর মহল থেকে লিখিত নির্দেশ আসার পরেই ফাইল আমার কাছে আসবে, তারপরেই বিল বানাতে পারব আমি। এরপরে ওই কর্মী আমাকে ২০ টাকা ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি রেগে গিয়ে তাকে ফের আমার অফিসে আসতে বারণ করি।”

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়ার দাবি যে ওই কর্মীর বোধহয় তার কথায় খারাপ লেগেছিল। সে তার পুলিশ কর্মী বাবাকে কিছু একটা বলে থাকবে। এই ঘটনার তিনদিন পরে আমি যখন অফিসে যাচ্ছি, তখন ওই কর্মী পিছন দিক থেকে এসে আমার পকেটে কিছু একটা গুঁজে দেয়।

মি. অওধিয়ার কথায়, “আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে আমাকে আটক করে বলে যে তারা দুর্নীতি দমন বিভাগের লোক আর আমাকে ১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

বাবার গ্রেফতারির সময় নীরজের বয়স ছিল ১৩, এখন তিনি ৫২

বাবার গ্রেফতারির সময় নীরজের বয়স ছিল ১৩, এখন তিনি ৫২

সেদিন থেকেই শাস্তির শুরু

জাগেশ্বর প্রসাদ বলছিলেন, ওই দিন থেকে শুধু তার নয়, পুরো পরিবারের শাস্তি পাওয়ার শুরু।

গ্রেফতার হওয়ার দুই বছর পরে আদালতে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হলে তাকে ১৯৮৮ সালে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সাসপেনশান চলে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এরপরে তাকে রায়পুর থেকে রেওয়া বদলি করে দেওয়া হয়।

তার অর্ধেক বেতন – মাত্র আড়াই হাজার ভারতীয় টাকায় সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী আর চার সন্তান রায়পুরেই থেকে যান, আর মি. অওধিয়া রেওয়াতে। পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি – সবই বন্ধ হয়ে যায়। এক এক করে চার সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

তার ছোট ছেলে নীরজ অওধিয়ার বয়স সেই সময়ে ছিল মাত্র ১৩ বছর। এখন ৫২ বছরের নীরজের আফসোস যে তার বাবার জীবনযুদ্ধ যে শুধু তাদের ছোটোবেলাটা আদালতের সিঁড়িতেই কেটেছে।

চোখের কোণে জমে ওঠা জল মুছে নীরজ বলছিলেন, “আমি তো তখন ঘুষ নেওয়ার মানেই বুঝতাম না, কিন্তু লোকে বলত ঘুষখোরের ছেলে। ছোটরা পেছনে লাগত। স্কুলে কোনও বন্ধু হয়নি, পাড়ায় সবাই দরজা বন্ধ করে দিত। আত্মীয়রা সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল। স্কুলের বেতন দিতে পারতাম না বলে বেশ কয়েকবার স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

জাগেশ্বর অওধিয়ার স্ত্রী ইন্দু অওধিয়া এই পুরো বোঝাটা নিজের ভেতরেই বইতেন। ধীরে ধীরে তিনিও এই সামাজিক শাস্তির চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে ২৪ দিন ভর্তি থাকার পরে সেখানেই তিনি মারা যান। পেছনে ফেলে রেখে যান একটি ভেঙে যাওয়া পরিবার।

জাগেশ্বর প্রসাদ বলছিলেন, “আমার স্ত্রী শুধু দুশ্চিন্তা করতে করতে চলে গেল। আমার ওপরে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আর তারপরে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পরে ও দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগছিল। ও ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল। আমার কাছে অর্থ ছিল না যে আমি ঠিকমতো ওর চিকিৎসা করাব। আমার মনে আছে যেদিন ও চলে গেল, অন্তিম সংস্কার করারও পয়সা ছিল না আমার কাছে। এক বন্ধু তিন হাজার টাকা দিয়েছিল, তা দিয়ে কোনোভাবে অন্তিম সংস্কার আর অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম সেরেছিলাম।”

'এই বয়সে যাতে আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়'

‘এই বয়সে যাতে আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়’

‘যাতে আর হাত না পাততে হয়’

বিচারিক আদালত ২০০৪ সালে মি. অওধিয়াকে দোষী বলে ঘোষণা করে। তবে সব সাক্ষীরাই নিজেদের বয়ান বদল করে ফেলেছিল। তা স্বত্বেও আদালত একবছরের জেল আর এক হাজার ভারতীয় টাকার জরিমানার আদেশ দেয়।

তবে তিনি হার মেনে নেননি। হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি, সেখানে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলা চলে।

সংসার চালানোর জন্য তিনি একেকবার একেক ধরনের কাজ করেছেন। কখনও ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে, কখন কোনও বাস মালিকের কাছে। বয়স হয়ে যাওয়া স্বত্বেও আট থেকে দশ ঘণ্টা কাজ করতে হত তাকে। মাত্র একশ টাকার অভিযোগে তাকে প্রায় ১৪ হাজার দিন অদৃশ্য এক কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে।

শেষমেষ ২০২৫ সালের সেই দিনটা এসেছিল, যেদিন হাইকোর্ট ঘোষণা করল যে তিনি নির্দোষ।

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া বলছিলেন, “ন্যায় বিচার তো পেলাম, কিন্তু সময়টা তো ফিরে আসবে না। স্ত্রীকে তো ফিরে পাব না, সন্তানদের ছোটোবেলাটা তো আর ফিরবে না।

“আর মান-সম্মান! সেটাও তো ফিরে পাইনি।”

হাইকোর্টের আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা শুক্লা বলছিলেন, ‘মি. অলিয়া এখন এই মামলায় ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নটা হলো অর্থ দিয়ে কি তার ভাঙাচোরা জীবনটা আর জোড়া লাগবে? ক্ষতিপূরণ দিয়ে কি তার চলে যাওয়া সময়টা আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? জাগেশ্বর প্রসাদের কাহিনি শুধু একজন ব্যক্তির ট্র্যাজেডি নয়। আমাদের গোটা বিচার ব্যবস্থার চেহারা সামনে এনে দিল – যে ব্যবস্থা আবার বিচারে বিলম্ব হওয়াকে অবিচার বলে মনে করে। কারও যৌবন আদালতে কাটছে তো কারও বার্ধক্য। আর যখন ফয়সালা হচ্ছে, ততক্ষণে অনেক কিছু শেষ হয়ে গেছে।”

জাগেশ্বর প্রসাদ অওধিয়া এখন চান যে সরকার অন্তত তার পেনশন আর বকেয়াটুকু মিটিয়ে দিক।

জীবনভর পরিশ্রম করার পরে এখন কারও কাছে যাতে আর হাত না পাততে হয়।

 

বিবিসি নিউজ হিন্দি, রায়পুর (ছত্তিশগড়)