মুষলধারে বৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় প্রদেশ ও হাইল্যান্ডস বিপর্যস্ত
ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চল আবারও ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়েছে। কয়েক দিনের অবিরাম ভারি বর্ষণে সৃষ্ট প্লাবনে অন্তত আট জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। টেলিভিশন ফুটেজ ও সরকারি ছবি দেখা যাচ্ছে—গ্রামাঞ্চলের অনেক বাড়ি অর্ধেকের বেশি পানির নিচে, মানুষ কোমর কিংবা বুকসমান পানিতে হাঁটতে হাঁটতে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন, আর উদ্ধারকর্মীরা নৌকা ব্যবহার করে আটকে পড়া বাসিন্দাদের তুলে আনছেন।
কেন্দ্রীয় উপকূলীয় প্রদেশগুলোর পাশাপাশি সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডস অঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। অনেক এলাকায় মানুষ জরুরি ভিত্তিতে উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অথবা স্কুল ও সরকারি ভবনে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। নিরাপত্তার কারণে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছে, ফলে অন্ধকার ঘরে থেকেও মানুষকে পানি ঠেকানো আর গবাদিপশু বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আবহাওয়া দফতর আরও বর্ষণের আশঙ্কার কথা জানায়, ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কফি উৎপাদন অঞ্চলে ফসলহানির আশঙ্কা
বন্যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়তে পারে ভিয়েতনামের কফি খাতে। দেশের অধিকাংশ রোবাস্টা কফি উৎপাদিত হয় সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডসে, যেখানে এখনই মূল ফসল তোলার সময়। তবে অনেক জেলায় কফি বাগানপথ ডুবে যাওয়ায় কৃষকেরা গাছের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না, কোথাও আবার পুরো প্ল্যান্টেশনই পানির নিচে। দীর্ঘ সময় প্লাবিত থাকলে কফি গাছের শিকড় নষ্ট হতে পারে, পেকে যাওয়া ফল গাছ থেকে পড়ে পচে যেতে পারে—যার প্রভাব পড়বে ২০২৫-২৬ মৌসুমের ফলন ও গুণমানের ওপর।
রোবাস্টা কফি রপ্তানিতে ভিয়েতনাম বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়, আর এই জাতের কফি ইনস্ট্যান্ট কফি ও এসপ্রেসো মিশ্রণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তাই সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডস অঞ্চলে উৎপাদন বিঘ্নিত হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা করতে পারে। ইতিমধ্যে অন্যান্য উৎপাদনশীল দেশে আবহাওয়া-জনিত ধাক্কা কফির বাজারকে অস্থির করে তুলেছে; ভিয়েতনামে নতুন এই বন্যা সেই চাপ আরও বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

সড়ক, সেতু ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি
কৃষিখাতের বাইরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক, সেতু ও ছোট ছোট বাঁধ। কিছু প্রধান মহাসড়কে ভূমিধস ও সেতুর অংশ ভেঙে পড়ার কারণে আংশিক বা পুরোপুরি যান চলাচল বন্ধ আছে, ফলে খাদ্য, জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রীবাহী ট্রাকগুলোকে লম্বা ঘুরপথে যেতে হচ্ছে। নিম্নাঞ্চলে মানুষ বালুর বস্তা ফেলে অস্থায়ী বাঁধ তুলছেন, ঘরের আসবাবপত্র উঁচু তলায় সরিয়ে রাখছেন—উজানের বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়তে হলে আবারও পানি বাড়তে পারে এই আশঙ্কায়।
বিপর্যয়ের ঘন ঘনতা ও জলবায়ু সংকট
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ও ভারি বৃষ্টির কারণে ভিয়েতনামে নানারকম বন্যা দেখা যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টিপাত আরও তীব্র হচ্ছে এবং আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ ও বন উজাড়—এসব কারণে নদী এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের পুনর্বাসনে বিনিয়োগের কথা বলছে, তবে বাস্তবায়নের গতি এখনো ঝড়-বন্যার গতির তুলনায় ধীর বলে অনেকে মনে করছেন।
মানুষের জীবন ও পুনর্গঠনের সংগ্রাম
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তরুণ স্বেচ্ছাসেবী দল নৌকায় করে শুকনো খাবার ও বোতলজাত পানি পৌঁছে দিচ্ছে, আবার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত কিছু স্কুলে অস্থায়ী কমিউনিটি রান্নাঘর চালু হয়েছে। বহু পরিবারের জন্য এটি কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বড় বন্যা; বারবার ঘরবাড়ি হারিয়ে তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে যাচ্ছে, পুনর্গঠনের সামর্থ্যও কমে আসছে।
মানবিক সংস্থাগুলো শুধু জরুরি ত্রাণ নয়, দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের ভাষায়, পুনঃপুন বিপর্যয় গ্রামীণ মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে, তরুণদের বাধ্য করছে শহর বা বিদেশে কাজ খুঁজতে। কোথাও পানি নামছে, কোথাও আবার বাড়ছে—এই ওঠা-নামার মাঝেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, জলবায়ু-সম্পর্কিত ধাক্কা এখন ভিয়েতনামের গ্রামীণ জীবন ও বিশ্ব কফি বাজার—দুয়োটিই পুনর্গঠন করছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















